হারিয়ে যাওয়া পুরনো বাড়ি, যুগ ও সেকাল আর একাল সম্পর্কে কিছু কথা

বৃহত্তর কলকাতায় জমি কিনে বাড়ী তৈরী বন্ধ হয়েছে কবে? আগে লোকে কোন রকমে এক কাঠা/সওয়া কাঠা জমি কিনে বানাতো নিজের বাড়ী। কলকাতায় না পারুক উপকণ্ঠে কোথাও। বাড়ী শুধু এক মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়। পরিবারের অঙ্গ। একজন জীবন্ত মানুষের মতোই। দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে তার সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। মানুষ বলেই ভাবতে হয় তাকে।

এপ্রিল 20, 2023 - 16:00
এপ্রিল 20, 2023 - 12:57
 0
হারিয়ে যাওয়া পুরনো বাড়ি, যুগ ও সেকাল আর একাল সম্পর্কে কিছু কথা
হারিয়ে যাওয়া পুরনো বাড়ি, যুগ ও সেকাল আর একাল সম্পর্কে কিছু কথা | Image Source: Suprobhat Bangladesh

ট্রেনে যেতে চোখে পড়তো প্লাস্টার বিহীন ঘেঁসের গাঁথনি একতলা ছোট্ট বাড়ী। নিচু জমিতে, সিঁড়ি ছাদ ডিজাইনে টিন বা টালি, তার উপর বেয়ে উঠেছে কুমড়ো লতা, বাউন্ডারি আপাতত বাঁশের বেড়া। তাও বুড়ো বয়সে। রিটায়ার করার পাওনা থেকে মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি আনুষঙ্গিক মিটিয়ে হাতের খুঁদ কুড়ো যা থাকতো তাতে ওর বেশী কিছু হতো না। মফস্বলে এখনো এই নিয়ম চালু থাকলেও মহানগরীতে আর কেউ বাড়ী করে না। ফ্ল্যাট কেনে। ফ্ল্যাট অবশ্য তখনো ছিল, তবে তাতে লোকে ভাড়া থাকতো।


আরও আশি
, একশো বছর আগে অধিকাংশ বাড়ী ছোট বড়ো তাতে উঠোন থাকতো। তার তিন দিক ঘিরে উঁচু বারান্দা, তার ভেতর দিকে বসত ঘর। এই চতুষ্কোণ উঠোন বা ‘চক’, তাকে ঘিরে যে বাড়ী, তারই নাম চকমেলান বাড়ী।


পাশ্চাত্যের বাড়ীর ভিতর উঠোনের প্রয়োজন হয় না। কারণ নারীরা পর্দানশীল নয়। পুরুষদের মতো তারাও যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে। এখানে বিপরীত তাই বাড়ীতেই মেয়েদের খোলা হাওয়ার আনন্দ দিতে উঠোন।


এই বিশেষ প্রয়োজন টি এখানকার বাড়ীর গঠন ভঙ্গীতে এক বিশেষ রুপ দিয়েছে। মাঝখানে উঠোন, তাতে ঘিরে ইমারত। ইমারতের একটা মুং সদর অন্যদিকে ইঁট চুনের থামের ওপর ‘মেহরাবদার’ (খিলান বা আর্চ) অন্দর দরজা।


এই বীজ টা কিন্তু আদতে মুসলমানি। হিন্দুরা তাতে রদবদল করে ঠাকুর দালানও ঢুকিয়ে নিয়েছে। অবশ্য সেটাই ঘটবার কথা। সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে শাসিতরা যতদুর পারে শাসককে নকল করে। একই ঘটনা মুসলমানদের বেলাও ঘটেছে।


মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারী পাশ্চাত্য স্থাপত্বের নকলন বিশি। তবে এটাও ভাবা ঠিক হবে না যে উঠোন মুসলমানি সংযোজন। কারণ উঠোন সিন্ধু সভ্যতাতেও ছিল, আর সারা ভারতেরই অঙ্গনবাড়ীর একটা অঙ্গ।



শহরের এই রকম এক বাড়ীর বর্ণনা দেওয়া যাক

সদর থেকে উঠোনে পৌঁছতে একটা গলি পেরোতে হত। তার দু’দিকের যে কোন একটা ঘর হতো বড়লোকের হলে বৈঠক খানা, সাধারন জনের বাইরের ঘর। সেই ঘর গুলোর দুটো দরজা, একটা বাইরের দিকে। অর্থাৎ গলিতে। আর একটা ভিতর বাড়ীর দিকে।


ঘরে অভ্যাগত থাকলে তার শিকল বেজে উঠতো অন্দর মহলের ডাক বোঝাতে। গলির দু’পাশে কেউ রকের মতো বাঁধিয়ে রাখতেন উঁচু করে আটপৌরে আড্ডার জন্য যাতে খালি গায়ে ধুতির খুঁট জড়িয়ে বসা যায়, বা ধোপা, নাপিত কাজ সারতে পারে, যাদের আপ্যায়নের প্রয়োজন নেই।


উঠোনে থাকতো কলতলা, জল ব্যবহারের যে সব কাজ সারার জন্য বাথরুমে ঢোকার দরকার হয় না তার জন্য। উঠোন আর স্নানের ঘর দু’জায়গাতেই কলের তলায় মুঙ্গেরি পাথর, বাথরুমের লাগোয়া কিন্তু আলাদা ঘর।


চব্বিশ ঘন্টা কলে জল থাকে না, তাই বাথরুমের একদিকে বিরাট চৌবচ্চা। উঠোন বলা বাহুল্য, পাকা, পুরনো বাড়ীতে টালি বাঁধানো। কাঁচা উঠোন, পাতকুঁয়ো আর ঢেঁকি এখনো কলকাতায় কিছু বাড়ীতে আছে বোধহয়!


একতলাতেই থাকবে রান্নাঘর আর ভাঁড়ার। খাওয়ার আলাদা কোন ঘর নেই। রান্নাঘরে বা বারান্দায় পিঁড়ি পেতে কাঁসার থালায় ভোজন। বেসিন
, টাওয়েলের বদলে বালতি মগ ও গামছা। এক কোণে ডাঁই করে রাখা ঘুপচিতে ঘুঁটে কয়লা আর কেরোসিনের বোতল।


দেওয়াল গুলো পনেরো ইঞ্চি মোটা, তাই বসবার জন্য জানলার নিচে বেশ এক একটা পৈঠা বেরুতো পা ঝুলিয়ে বসতে আর বাইরে উঁকি মারা যেত খড়খড়ি ফাঁক করে। সব ঘরের অবশ্য চৌকাঠ পেরোতেই হতো। সব ঘরের দেওয়ালে তিন চার খানা নানা সাইজের কু্লুঙ্গী।


ছাদ নিদেন পক্ষে বারো ফুট উঁচুতে, দরজা সাড়ে তিন চার ফিট চওড়া, সাড়ে ছ’সাত ফুট উঁচু, সদর দরজা আরও বড়ো সড়ো। দোতলা তিন তলায় আলো, বাতাস বেশী, পেল্লায় সাইজের খাট – আলমারি, সিন্দুকে ভরা। খাটের তলা নানা সাইজের ট্রাংকে ভর্তি। তাদের মধ্যে ন্যাপথলিন ও কালো জিরে মোড়া কত কি!


তখনকার ছাদ এখন কার মতো কনক্রিট নয়। এক বা একাধিক লোহার বা কাঠের বিম বা কড়ি। তার ওপর আড়াআড়ি কাঠের বরগা। তার ওপর চুন, সুড়কি, ইঁটের খোয়ার পেটানো ছাদ। এখন কড়িকাঠ নেই, তাই আগে যারা কড়িকাড় গুনতো, তারা এখন শুয়ে শুয়ে মোবাইল টেপে। ছাদের যে অংশে আর ঘর হবে না, সেখানে বানানো হতো পিটিয়ে জল ছাদ। অর্থাৎ ছাদ কে ওয়াটার প্রুফ করা।


সে এক বিরাট ফইজত। ছাদ পেটানো চলতো আটদিন ধরে। ছাদে কার্নিশ থাকতো। ছাদের কোণে চিলেকোঠা, কারও আবার ঠাকুর ঘর, কারো বিশাল বিশাল ট্যাংক সংগে গঙ্গাজলেরও। বাড়ী বলতে গিয়ে উঠোন বাদ পড়ছে। উঠোন একটা বাড়ীর মান মর্যাদা।


বড়লোকের বাড়ীতে সদর দরজা পেরিয়ে বিশাল উঠোন। তার পর দুর্গা দালান তার সামনে হাড়িকাঠ  আর বৈষ্ণব বাড়ী হলে নাটমন্দির, সামনে তুলসিমঞ্চ। পুজার দালান মর্যাদা বুঝে তিন ফুঁকুরি, পাঁচফুকুরি, সাত ফুঁকুরি হতো।


কলকাতায় জোড়াসাঁকো রাজবাড়ীতে বিশাল উঠোনের আলাদা মর্যাদা। সেই উঠোন ঘিরে দো মহলা, তিন মহলা বার বাড়ী, সদরমহল, অন্দরমহল কত নাম। বড়লোকের বাড়ী বিরাট হতো।


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ এর  নগেন্দ্রনাথ এর গোবিন্দপুরের বাড়ী ছিলো সদর বাড়ীও তিন মহলা, অন্দর মহলও তিন তলা। ১৮৮৫ সালে দেওঘর এ রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রর কাছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। যে দিক দিয়েই ঢুকছেন, সদর দরজা উল্টো দিকে পড়ছে।


এখনকার পাঠকের জন্য জানানো দরকার - আজকাল কলকাতার প্রোমোটার যে বাড়ি জমির দায়িত্বে আছেন তাঁরা ৭২০ স্কোয়ার ফিটে এক কাঠা ও ২০ কাঠায় এক বিঘা, এমন তাদের মতে।


উঠোন ছাড়া এক ধরণের বাড়ী হতো উনিশ শতকের শেষের দিকে তাকে বলা যায়, কেজো বাড়ী। বসত বাড়ী রুপে আবার অফিস, দপ্তর স্কুল, চিকিৎসা কেন্দ্র যে কোনও রুপে।


রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, জোড়াসাঁকোয় এক সাহেব ইঞ্জিনিয়ার বাড়ী বানাতে এসে নিজের নাম ইংরেজিতে কিন্তু নিজের পেশা থাকতো বাংলায়। তিনি নিজ নাম, Mr George Edward Eves লিখে পেশা লিখলেন, গৃহনির্মান কর্তা


উঠোন ওয়ালা বাড়ী যখন রুপকথা হয়ে যাবার তখন এক ডায়লগ বলা যায়,


বাড়ী তুমি কে?

- যে আমাকে যেমন ভাবে!


বাড়ী শুধু এক মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়। পরিবারের অঙ্গ। একজন জীবন্ত মানুষের মতোই। দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে তার সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। মানুষ বলেই ভাবতে হয় তাকে।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392