চলে গেলেন শ্রী গোপেশ রঞ্জন শীল, শোকাহত বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার সদস্যরা
বিশিষ্ট লেখক, ভিলাই (ভারত) বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার সক্রিয় সদস্য ও “মধ্যবলয়” পত্রিকার সহ-সম্পাদক শ্রী গোপেশ রঞ্জন শীল গত (২৫শে এপ্রিল, ২০২২) পূর্বাহ্নে প্রয়াত হয়েছেন। কিছু শারীরিক সমস্যার জন্যে শ্রী গোপেশ রঞ্জন শীল গত ২৫শে এপ্রিল ভিলাই -এর “Mittal Hospital” -এ ভর্তি হন, বেলা ১১টা-১৫টা নাগাদ সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে আমরা হারালাম আমাদের এক অত্যন্ত প্রিয় মানুষকে।

গোপেশ রঞ্জন শীল গত ২৫ এপ্রিল ২০২২ চলে গেলেন সেই না ফেরার দেশে। আমাদের সাহিত্য সভা আঁধার করে। আমাদের বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার এক প্রবীণ ও প্রিয় সদস্য। এক বিদগ্ধ সাহিত্যিক এর অবসান ঘটলো। তিনি ‘মধ্যবলয়’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। এক অনাবিল হাস্যমুখের সজ্জন এক বিরল ব্যক্তি। ব্যক্তিগত জীবনে তেরো বছর অবসর প্রাপ্ত আর্কিটেকট ছিলেন। তিনি সাহিত্যসভায় আসতেন, শান্ত, সৌম্য চেহারায় একধারে বসতেন, শুনতেন, বলতেন না বেশী।
পূর্বে তাঁর সাথে আমার পরিচয় খুব বেশী ছিলো না। যতটুকু সাহিত্য সভাতেই যে টুকু সীমাবদ্ধ ছিলো। পরবর্তী পর্যায়ে কেমন করে জানি না এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। করোনা কাল ও আমাদের বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যক প্রণম্য ‘শিবব্রত দেওয়ানজী’ দাদার দেহাবসানের মিশ্রিত কারণে আমাদের সাহিত্য সভা বছর খানেক দুয়ার খোলেনি।
সেই সময়ে একদিন আমাদের আর এক প্রিয়, বরিষ্ঠ সদস্য বন্দনা সিনহা ফোনে আমায় একান্ত অনুরোধের ফলে আমার গৃহে সাহিত্য সভার আয়োজন করেছিলাম। সেই যথোচিত সংক্ষিপ্ত আয়োজনে এক নাগাড়ে ছ’ছটি কবিতা আবৃত্তি করে বন্দনা আমাদের চমকিত করেছিলো- এই না কি তার অসুস্থতা!
সেই সভাতে গোপেশ রঞ্জন শীল তাকে ‘ধন্যি মেয়ে’ আখ্যায় বিভুষিত করেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ বলা সেই ধন্যি মেয়েও এই পৃথিবী ছেড়ে আমাদের কাছ হতে অনেক দূরে চলে গেছে। তারপর একদিন দুপুরে দ্বি-প্রাহরিক আহার গ্রহণ করছি, একটি চিঠি আমার নামে এলো - পোস্ট অফিসের ছাপ মারা, ডাকপিয়নের হাত মারফৎ। আজকাল তো বহুদিন পত্রাদি আদান প্রদান রুদ্ধ হয়ে রয়েছে, কে দিলো!
দেখি পত্র প্রেরক তখন (শ্রী-হীন নয়) গোপেশ রঞ্জন শীল। দীর্ঘ, দু’পাতা লম্বা চিঠি। আমার গৃহের সাহিত্যসভা, আমারও, সেদিন উন্মেচিত আমার বইয়ের উচ্ছসিত ও ভুয়সী প্রশংসা চিঠিখানিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আমি উৎফুল্লিত হয়ে সৌজন্যবশতঃ তাঁকে একটি উত্তর বার্তা পাঠালাম পোস্ট অফিস মারফৎ। সেই যে শুরু হলো আজও সেই পত্র ব্যবহারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থেকেছে। কত চিঠি যে দুজনের কাছেই জমা হতে লাগলো তার সীমা নেই।
আমি বলেছিলাম, “আমদের এই চিঠি লেখালেখি এক নতুন অধ্যায় শুরু করলো। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সাহিত্যর এক ধারা - পত্র সাহিত্য।”
তিনি হেসে বলেছিলেন, “আমি তো আপনার মতো যোগ্য নই এই ব্যাপারে!” এটা যে তাঁর নিতান্তই অতি বিনয় সূচক ভদ্রতা, তা বলাই বাহুল্য! তাঁর এক ধারাবাহিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছিলো- ‘খয়রাগঢ় এর রাজবাড়ী ও সংগীত’ বিষয়ে মধ্যবলয় এ।
তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন লেখা পত্র নিয়ে। তাঁর কিছু বই ও প্রকাশিত হয়েছে। কিছু রচনার তিনি সম্পাদনাও করেছেন। কিছু লেখকের রচনায় ‘ভূমিকা’ লিখে দিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগত রুপে দুঃখিত ও লজ্জিত এ বিষয়ে অধিক অনভিজ্ঞতার জন্য।
গোপেশরঞ্জন শীল পরিবার গত জীবনে এক স্নেহশীল পিতা- যিনি দীর্ঘদিন জীবন সঙ্গিনী হারা পুত্র কন্যাকে সংরক্ষন করে মানুষ করে তুলেছেন। আমার মনে হয় এই মানুষটি নিজেকে একটু আড়াল করে রাখতেই ভালবাসতেন, কিন্তু গুণের তো তাঁর সীমা ছিলো না!
আমার সঙ্গে ধীরে ধীরে ফোন মাধ্যমে কথা বার্তার দ্বারা আমি অনুভব করেছিলাম- তিনি সাহিত্যসভায় প্রায় নিঃশব্দ থাকলেও কত জ্ঞান তাঁর দেশ বিদেশের সাহিত্য বিষয়ে ও কত পাঠ করেন তিনি। অথচ আমায় প্রায়ই পরিহাসে ফোনে বলতেন, “আপনার মতো তো আমি সুখী বসে থাকিনা; ঘরের অনেক কাজ করতে হয়, নাতনীদের দেখাশুনা করতে হয়।”
শেষের দশ বা বারো দিন এই বাক্যালাপ, চিঠি লেখা খানিকটা ব্যাহত ছিলো, তাই তো জানতে পারিনি কবে তাঁর দিন কয়েক কলকাতা যাওয়া ফেরা, অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল অ্যাডমিট।
আর আজ তো শেষ মুহুর্তে শেষ খবর পেলাম, হৃদয় ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো, হতবাক হয়ে গেলাম। তাঁর শেষ চিঠি খানা এখনো টেবিলে পড়ে, জবাবের অপেক্ষায়! জানি না কোন পোস্ট অফিসের ঠিকানায় কোন ডাকপিয়নের হাত দিয়ে পাঠাবো তাঁকে এর জবাব!
কিছুদিন পাওয়া আমার সহৃদয় নিকট বন্ধু কে আমি এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেললাম! কিন্তু ‘পত্র সাহিত্য’ আমি বন্ধ করবো না। চিঠি লিখতে থাকবো, জানি উত্তর পাবো। মনে আঁকা থাকবে- সেই শেষক্ষণ, শেষ সাক্ষাৎ, কফি হাউস, মধুদা (সাহিত্যিক) আর ফেয়াটওয়েল।
আজ ২৬ মার্চ তাঁর বাড়ীতে কফিন এ শীতল ঠান্ডা শয্যায় শয়াণ তাঁর সাথে দেখা করে এলাম।
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?






