বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী ও সাহিত্যকর্ম

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিশ্ব নন্দিত ব্যাক্তি। তার পুরো জীবন ছিল কর্মময়, তাই অল্প কথায় তার জীবন সম্পর্কে আলোচনা সম্ভব নয় তবুও আজকে আপনাদের কিছু বিষয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব। চলুন জেনে আসি।

জুল 27, 2023 - 15:00
জুল 27, 2023 - 17:28
 0
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী ও সাহিত্যকর্ম
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী ও সাহিত্যকর্ম | Image Source: BBC

জন্ম ও বংশ পরিচয়

কলকাতার সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে ইংরেজিতে ৭ মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পিতার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ও দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথের মাতার নাম সারদা দেবী। পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান হিসেবে তিনি ঠাকুর পরিবারে আসেন।


পারিবারিক প্রেক্ষাপট

৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে তৎকালীন অধ্যুষিত অঞ্চল জোড়াসাঁকোতে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পারিবারিক বাসভবন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজা রামমোহন রায় ঘনিষ্ট মিত্র ছিলেন এবং ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক।


এরপর রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন এবং তাকে মহর্ষি উপাধিতিতে ভূষিত করেন। অস্পৃশ্যতা প্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন।


শৈশব ও কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ

পিতার তত্ত্বাবধানে কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশব অতিবাহিত হয়। ১৪ বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। তাই পারিবারিক স্নেহ ও আদর থেকে বঞ্চিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমন কি পিতার সান্নিধ্য পাননি, কারন তার বাবা ইংল্যান্ড এবং উত্তর ভারত সহ বিভিন্ন স্থানে সফরে ব্যস্ত থাকতেন।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্যকাল তাঁর বিদ্যালয়ের গন্ডির বাইরে পা রাখার সুযোগ কম পেতেন। তবে সাহিত্যিক হিসেবে তার খ্যাতি লাভ করার পিছনে তার বাল্যকাল পারিবারিক গন্ডির মধ্যে থাকায় এক বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। যেমন তার বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এক সম্মানীয় দার্শনিক এবং কবি।


পাশাপাশি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রথম হিসেবে সম্মান পান তার মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমকালীন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হিসেবে এক নামে চিনতো স্বর্ণ কুমারী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয় তার ভালো বন্ধু কাদম্বরী দেবী।


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর অনুপ্রেরণাতেই রবীন্দ্রনাথ এর রচনাতে এক বিশাল আকারের অনুপ্রেরণা পায়। যা তার পরবর্তীতে এক সাহস ও উদ্দীপনা যোগায়।



শিক্ষাজীবন

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ শুনিতে পাই, ইচ্ছা যেখানে পথ সেখানেই আছে।চার দেয়ালের মধ্যে স্কুল জীবনের শিক্ষা ব্যবস্থা তাঁর কোন কালেই পছন্দের ছিল না। সাধারণ শিশুদের মতো ৪-৫ বছর বয়সে শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়াশুনা। এরপর বিভিন্ন স্কুল, একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেনতারপর কলকাতাঁর ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হন।


কিছুদিন পর জ্ঞান অর্জনের জন্য বেঙ্গল একাডেমি যান। আবার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল ও যান অধ্যয়ন এর জন্য। কিন্তু বেশি দিন মন টিকে রাখতে পারলেন না। এর পিছনে প্রধান কারণ ছিল স্কুল শিক্ষার প্রতি অনীহা। এসব কারনেই তার পিতামাতা আর বড় দাদার প্রচেষ্টায় গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতে পড়ার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তীতে পিতার সঙ্গে একবার গেলেন বোলপুরে শিক্ষা গ্রহণ এর জন্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বরাবরই ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী।


সেখানের প্রকৃতি যেন কবির মন নাড়া দেয়। একবার শান্তিনিকেতনে অপরূপ সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে অনেক রচনার সৃষ্টি করেছিলেন। এরপর গেলেন ডালহৌসির পাহাড়ে। মূলত স্কুলের বদ্ধ পরিবেশে পড়াশোনা করার এই রীতি তাকে কোন ভাবেই বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করতে দেয়নি।


এইভাবেই বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জ্ঞান অর্জন করতে করতে শেষ হলো তার বাল্যকাল।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সতের বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে যান। লন্ডনে তিনি ব্রাইটন ও উবের মদিনা বিলায় ঠাকুর পরিবারের একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন এবং সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু হয়।


সেখানে বাইসনের বা ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনে আইন বিদ্যা নিয়ে জ্ঞান যাত্রা শুরু করেন। তবে দেড় বছর ইংল্যান্ডে থাকবার পর তাকে দেশে ফিরতে হয়। ব্যারিস্টারি পড়া তাঁর শেষ পর্যন্ত হয়নি। ডিগ্রি ছাড়াই চলে আসেন  দেশে।


কিন্তু এদিকে তার সাহিত্যের প্রতিভার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন ব্যাপক ভাবে।তার লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করল।


বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন

লন্ডন থেকে ফিরার ৩ বছর পর তিনি বিবাহ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।ছেলেবেলায় নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর সাথে কবিগুরুর গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান। তারপর ২২ বছর বয়সে ভবতারিণী দেবীর সাথে তার বিয়ে হয়।


তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়িরই এক অধঃস্তন কর্মচারী বেনীমাধব রায়চৌধুরীর একাদশ বর্ষীয়া কন্যা। বিবাহের পর তার স্ত্রী-এর নাম হয় মৃণালিনী দেবী। তার বিবাহবন্ধনে মোট পাঁচজন সন্তান হয়েছিল। তারা হলেন যথাক্রমে মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেনুকা, মীরা, এবং শমীন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে রেনুকা এবং শমীন্দ্রনাথের খুব অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়।



কর্মজীবন

আসলে রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবন এতটাই ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল যে তা নিয়েই এই ছোট পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথ পেশাগতভাবে জমিদারি সামলানো, খাজনা আদায় এবং মহাল পরিদর্শনের মত বৈষয়িক কাজে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন।


বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসবার পর ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া জেলা, রাজশাহী, পাবনা তথা উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে পারিবারিক জমিদারিগুলি দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথ নিয়োজিত হন। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ১৮৯১ সালে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা পাবনা উড়িষ্যা ঠাকুর পরিবারের জমিদারি দেখাশোনার  করার জন্য বাংলাদেশে যান।


বাংলাদেশে গিয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠির বাড়িতে তিনি দীর্ঘ সময় পার করেছিলেন তার জীবনের। নিজের পারিবারিক বজরায় চড়ে তিনি এই জমিদারিগুলির তদারকিতে যেতেন। প্রজাদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয় কবিগুরুর সম্মানে গ্রামবাসীরা জমিদারের উপস্থিতিতে ভোজসভার আয়োজন করত। তিনি এককথায় পেশায় ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, গল্পকার।



সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ

বাল্যকালেই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ এর সাহিত্য রচনার প্রবনতা ।তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। অভিলাষ তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা । তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প রচয়িতা এবং বাংলা ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তার লেখনীতে বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটেছে। তার ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলোর সমতুল্য।


দীর্ঘ ১২ বছর পারিবারিক জমিদারীর কাজে শিয়ালদহ ও শাহজাদপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা কবিতাটি লিখেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক অবদান রয়েছে। দাদার অনুপ্রেরণায় চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি বনফুল নামে একটি কাব্য রচনা করেন।


মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছোটগল্প লেখক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে  ভিখারিনী গল্প রচনার মাধ্যমে। এরপর কবিকাহিনী, সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল প্রভৃতি কাব্য একের পর এক প্রকাশিত হয়। ১৮৮২ সালে কলকাতা ১০ নং সদর স্ট্রিটে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি রচনা করেন।


এটি তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের ইঙ্গিতবাহী কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নবজাতক কাব্যের ভূমিকায় লিখেছিলেন, আমার কাব্যে ঋতু পরিবর্তন ঘটেছে বারে বারে। অর্থাৎ কাব্য সাধনায় তাঁর বার বার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বয়ে চলাই ছিল রবীন্দ্র কবি জীবনের ধর্ম।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ছাত্র, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ