দৃষ্টিহীন ফয়সাল মাসে ইনকাম করে আড়াই লাখ টাকা

দৃষ্টিহীন হয়েও ফয়সাল প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা ইনকাম করছে। মূলত ফ্রিল্যান্সিং করে ফয়সাল প্রতি মাসে আড়াই লক্ষ টাকার মতো উপার্জন করে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনুবাদ করে ফয়সাল অনেক অর্থ উপার্জন করে। এই ব্যাপারে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।

অগাস্ট 12, 2023 - 13:45
অগাস্ট 17, 2023 - 02:37
 0
দৃষ্টিহীন ফয়সাল মাসে ইনকাম করে আড়াই লাখ টাকা
দৃষ্টিহীন ফয়সাল মাসে ইনকাম করে আড়াই লাখ টাকা | ছবি সংগৃহীত

ফয়সাল মোহাম্মদ মাত্র ৯ মাস বয়সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। মূলত দুনিয়ার আলো দেখতে পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টা সেই বয়সে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ সেই সময়টাতে অনেকটাই পরিবারের উপর নির্ভর করে চলা যায়। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার এই দৃষ্টিশক্তি না থাকার বিষয়টা তাকে পদে পদে বাঁধাগ্রস্ত হতে বাধ্য করেছিল। তার নিয়তি হয়েছিল মূলত দমে যাওয়া। মূলত এই নিয়তিটাকেই ফয়সাল উল্টে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এখন সেই ফয়সাল একজন পেশাদার অনুবাদক হিসেবে কাজ করছে। তিনি মূলত রোহিঙ্গাদের এবং বাংলা ভাষার লেখালেখি ইংরেজিতে অনুবাদ করে থাকেন। 


এতেই তার প্রত্যেক মাসে আয় চলে আসে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। এখন ফয়সাল মোহাম্মদের বয়স ২৬ বছর। এর পাশাপাশি ফয়সাল মোহাম্মদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র। ফয়সালের বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে, দুই ভাই ও চার বোন এর মধ্যে তিনি চতুর্থ। মুলত ১৯৯৬ সালে বাবার কর্মস্থল সৌদী আরবে ফয়সালের জন্ম হয়েছিল। 


জন্ম নেওয়ার মাত্র ৩ মাস পরেই তিনি জলবসন্ত রোগে হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় সোদী আরবের একটি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন এবং সেখানেই তিনি তার চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফয়সাল এর বাবা জানা সেই সময় জলবসন্ত সৌদী আরবে একটি অজানা রোগ হিসেবে পরিচিত ছিল আর সেই কারনে তার ছেলেকে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে তিনি দাবি করেন


ফয়সালের বয়স ৫ বছর সেই সময় তারা সবাই বাংলাদেশে চলে আসে রাঙ্গুনিয়ার একটি মাদরাসায় সেইসময় ফয়সাল ভর্তি হয়। সেখানে পড়াশোনা করার জন্য অনুকুল পরিবেশ না পাওয়াই তিনি কিছুদিন পর ভর্তি হোন মুরাদপুরে অবস্থিত দৃষ্টি ও বাক-শ্রবন প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ে। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন শ্রুতলেখকের মাধ্যমে। উচ্চমাধ্যমিক পড়াশুনা করেন নগরের সরকারি সিটি কলেজ থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত বছর তিনি স্নাতক পাস করেন। বর্তমান তিনি স্নাতকোত্তরের ছাত্র


নতুন ভাষায় নতুন জীবন গড়েন 

রোহিঙ্গাদের ব্যবহৃত ভাষার সাথে মূলত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অনেকটাই মিল রয়েছে। সেই সুযোগে ফয়সাল অল্প কিছুদিনের ভিতরেই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা ভাষাটি শিখে নিয়েছিল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে তার একটি ভালো সম্পর্ক ছিল এবং তারই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি অনুবাদ নিয়ে কাজ করতেন। ইংরেজি ভাষা ও রোহিঙ্গা ভাষার বিভিন্ন লেখালেখি তিনি তাদের বাংলা অনুবাদ করে দিতেন।


২০২০ সালের শুরুর দিকে তিনি তার সহকারীর কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং এর বিষয়টি জানতে পারে। তার সেই সহপাঠী রিয়াজউদ্দিন তাকে বলেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অনুবাদের চেয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যদি সে যোগ দেয় তাহলে তার আয় কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে। এমনকি তার সেই সহপাঠী রিয়াজউদ্দিন ফয়সালকে একজন ভারতীয় ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। আর সে ভারতীয় ফ্রিল্যান্সার তাকে শিখিয়েছিলেন কিভাবে ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে অনুবাদের কাজ করতে হয়।


ফয়সালের কাছে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন তার দৃষ্টিশক্তি না থাকার দরুন সবাই তাকে বলতো তাকে তার বাবার সম্পদের উপর নির্ভর করে চলতে হবে এবং তার আশায় বেঁচে থাকতে হবে। আমি নিজে কখনো স্বাবলম্বী হতে পারব এটা কেউ কখনো ধারণা করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর যখন তিনি তৃতীয় বর্ষে করছিলেন তখন থেকে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এর কাজ শুরু করেছিলেন।  ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে ভারতীয় সেই ফ্রিল্যান্সার তাকে অনুবাদের কাজ দিতে শুরু করে। প্রথম অবস্থায় তার প্রতি মাসে ইনকাম ছিল ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।


যেভাবে তার আয় বাড়লো
 

ভারতীয় শেখ ফ্রিল্যান্সারের সাথে ফয়সাল প্রায় এক বছরের মত কাজ করেছিল। সে ভারতীয় ফ্রিল্যান্সারের কাছ থেকেই তার মূলত এই কাজের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নেওয়া। ২০২১ সালের জুলাই মাসে মার্কিন একটি কোম্পানি লাইন ব্রিজ সেখানে ফয়সাল আবেদন করেছিল এবং সেখানে ভাগ্যক্রমে তিনি অনুবাদকের কাজ পান। তিনি মূলত এখনো সেখানেই কাজ করছেন


এখন তিনি সেখানে বাংলা এবং রোহিঙ্গা ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং ইংরেজি ভাষা থেকে রোহিঙ্গা ভাষায় লেখালেখি অনুবাদ করেন। প্রত্যেক মাসে প্রায় সাত থেকে আটটি কাজ পান তিনি। সেইখান থেকে তার মাসিক বেতন আসে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংস্থা ওয়াইজ এর মাধ্যমে


একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় গত ৩ মাসে ফয়সালের ইনকামের একটি তালিকা। যেখানে গত এপ্রিল মাসে ২ হাজার ২২৮ মার্কিন ডলার, মে মাসে আসে ১ হাজার ৯৯৪ ডলার, জুন মাসে আসে ২ হাজার ৭৩২ মার্কিন ডলার। এই ৩ মাসে তার আয় হয়েছে মোট ৬ হাজার ৯৫৪ মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে তার প্রতি মাসের গড় আয় মুলত ২ লাখ ৫১ হাজার টাকা


বাবা-মায়ের সার্থক সন্তান  

ছেলেরা এমন সফলতার গল্প বলতে গিয়ে নিজেদের অশ্রু ধরে রাখতে পারছিলেন না ফয়সালের বাবা-মা। ফয়সালের বাবা-মা জানান ছোটবেলা থেকে ফয়সালের প্রতি তাদের বেশি স্নেহ ছিল। তারা ফয়সালকে নিয়ে শুধু একটাই চিন্তা করত তাদের অবর্তমানে ফয়সালের কি হবে সেটা নিয়ে। তারা জানান এখন আর তাদের কোন চিন্তা নেই তাকে নিয়ে।


এ ব্যাপারে সমাজতত্ব বিভাগের সরকারি অধ্যাপক আসমা আক্তার বলেন ফয়সাল একজন প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও সে প্রতিবন্ধকতা তার জীবনে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও সে যেভাবে নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে এবং উঠে দাঁড়িয়েছে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে সেই অনুভূতিটা অবর্ণনীয়। তিনি আরো জানান ফয়সালের এমন সফলতা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার বিষয় হিসেবে দাঁড়াবে।”

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

মো: বুলবুল আহমেদ ছাত্র আজিজুল হক কলেজ