নেলসন ম্যান্ডেলা ব্রিটিশ দক্ষিণ আফ্রিকার এমভেজোর এর এক অভিজাত পরিবারে ১৮ জুলাই, ১৯১৮ সালে এমভেজো, দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আইন বিষয়ে ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং তিনি জোহানেসবার্গে একজন আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবী অবস্থায় সেখানে তিনি উপনিবেশ বিরোধী কার্যক্রম ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এ যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সশস্ত্র সংগঠন উমখন্তো উই সিযওয়ের নেতা হিসাবে নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তিনি ২৭ বছর কারাগারে ছিলেন। তিনি কারাগারে থাকাকালীন অধিকাংশ সময়ই ছিলেন রবেন দ্বীপ, পলসমুর কারাগার ও ভিক্টর ভার্স্টার কারাগারে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এবং বর্ণবাদী গৃহযুদ্ধের আতঙ্কে রাষ্ট্রপতি এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারামুক্ত করার নির্দেশ দেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা কারামুক্তি লাভের পর দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে বর্ণবাদ নিপাতের প্রচেষ্টায় শান্তিচুক্তির আলোচনায় অংশ নেন। এর ফলে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এই নির্বাচনে নেলসন ম্যান্ডেলা তার দল যার নাম এএনসি'র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং জয়লাভ করে তিনি রাষ্ট্রপতিত্ব গ্রহণ করেন।
এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা ২৫০ টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো ভারত সরকার প্রদত্ত ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতরত্ন পুরস্কার এবং ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল শান্তি পুরস্কার।
এছাড়াও ১৯৮৮ সালে তিনি শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা তার গোত্রের নিকট মাদিবা নামে পরিচিত ছিলেন, যার অর্থ হলো, ‘জাতির জনক’।
নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং এক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাগরিক। তিনি ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে হাউটন এস্টেট, জোহানেসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত প্রিয় নেতা ও বক্তা হিসেবে ছিলেন দারুণ।
তার বিখ্যাত কিছু উক্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উক্তি হলো –
১. আমার সফলতার ভিত্তিতে আমাকে বিচার করো না, আমাকে বিচার করো আমার ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়ানোর ভিত্তিতে।
২. আমি সাধু নই, তবে যদি সাধুকে এমন এক পাপী হিসেবে বিবেচনা কর, যে সৎ হবার জন্য তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমি তাই।
৩. ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।
৪. যদি কেউ ঘৃণা করতে শেখে তাহলে সে ভালবাসা শিখে নিতে পারে। ঘৃণা নয়, মানব হৃদয়ে স্বাভাবিকভাবে ভালবাসার জন্ম হয়।
৫. ঘৃণা নিয়ে কেউ জন্ম গ্রহণ করে না।
৬. সাহসী মানুষের শান্তির জন্য ক্ষমা করতে ভীত হয়ে পড়েনা।
৭. পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি যতটা অর্জন করতে পারবেন, তার চেয়ে ঢের বেশী অর্জন করতে পারবেন ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
৮. যেখানে এক সময় থাকে বেদনার বসবাস, খেলাধূলা সেথায় করতে পারে আশাবাদের চাষ।
৯. পেছন থেকে নেতৃত্ব দাও - আর সাথে অন্যদের বিশ্বাস দাও যে, নেতা আছে সম্মুখসারিতে।
১০. আমি বর্ণবাদকে ঘৃণা করি কারণ এটা একটা বর্বর বিষয়, তা সে কালো বা সাদা যে কোন মানুষের কাছ থেকে আসুক না কেন।
১১. সবসময়, যতক্ষণ না কাজ সমাধা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তা এক অসম্ভব বিষয় বলে মনে হয়।
১২. যে কোন কিছুতে ভীত নয়; সে নয়, বরঞ্চ যে ভয়কে জয় করে সেই হচ্ছে প্রকৃত সাহসী।
১৩. সম্মান তাদের প্রাপ্য, যারা কখনো সত্যকে পরিত্যাগ করে না, এমনকি যখন পরিস্থিতি অন্ধকারচ্ছন্ন এবং বেদনাদায়কও হয়।
১৪. কেবল শৃঙ্খলহীন হওয়া নয়, বরং স্বাধীন হওয়া মানে শ্রদ্ধা এবং অন্যের স্বাধীনতা বৃদ্ধির সাথে বসবাস করা।
১৫. শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীকেও বদলে ফেলা যায়।
আরো পড়ুনঃ অমর্ত্য কুমার সেন: নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক সম্পর্কে জানুন