বর্ণ পরিচয়, বহুবিবাহ, বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা অর্জনের ফলে বিদ্যাসাগর সে শতকের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেই মূল্যায়ন অদ্যাবধি বিদ্যমান। এ-বছর, ২০২০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। তাঁর অনন্য জীবনদৃষ্টি এবং অসাধারণ কর্মসাধনার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এপার-ওপার বাংলায় বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হচ্ছে।

বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন একাধারে সংস্কৃত পণ্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় হলেও উপাধি ‘বিদ্যাসাগর’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।
গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষাশেষে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থকষ্ট সত্ত্বেও তাঁকে অধ্যয়নের জন্য কলকাতা পাঠান। সেখানে তিনি ১৮২৯ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। সংস্কৃত তাঁর অধ্যয়নের মূল বিষয় হলেও বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। অসাধারণ প্রতিভার কারণে কলেজের সমুদয় পুরস্কার ও বৃত্তি তাঁর হস্তগত হয়। কাব্য, অলঙ্কারশাস্ত্র, বেদান্ত, স্মৃতি, জ্যোতিষ ও যুক্তিবিদ্যায় তাঁর কৃতিত্বের জন্য ১৮৩৯ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
বিদ্যায়তনিক লেখাপড়া সমাপ্ত করে ১৮৪১ সালে বিদ্যাসাগর প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ‘প্রধান পণ্ডিতে’র পদে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি ইউরোপীয় রাজকর্মচারীদের বাংলা ভাষা শেখাতেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মেজর জি.টি. মার্শাল তাঁর এক সুপারিশপত্রে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বলেছিলেন, “তিনি ইংরেজি ভাষায় উল্লেখয়োগ্য জ্ঞান অর্জন করেছেন।”
আমার ধারণা এঁর মধ্যে অসাধারণ পরিমাণে, ব্যাপক ধরনের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, শ্রমশীলতা, সুন্দর স্বভাব এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার যোগ্য নৈতিক চরিত্রের একত্র সম্মিলন ঘটেছে। ১৮৫০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরের বছর অধ্যক্ষ পদে উন্নীত হন।
অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার সময় ১৮৫০ সালে সরকার তাঁকে হুগলি, বর্ধমান মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলার বিশেষ স্কুল পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করে। এছাড়া তিনি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি, বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সদস্য ছিলেন।
১৮৫৮ সালে যাঁরা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৮৭৭ সালে তিনি ইম্পেরিয়াল অ্যাসেমব্লিজ-এ সম্মাননা সনদ লাভ করেন এবং ১৮৮০ সালে সি.আই.ই.হন।
বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সমসাময়িক লেখকদের তুলনায় ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। তাঁর লেখা সৃষ্টিশীল ছিল না, ছিল শিক্ষা ও সংস্কারমূলক এবং উপযোগবাদী। ‘মহাভারত উপক্রমণিকা’ এবং ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ সহ তাঁর প্রথমদিকের রচনাসমূহ ছিল অনুবাদকর্ম এবং এগুলি ছিল স্কুলছাত্রদের পাঠ্যবিষয়ক।
‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ মূল রচনাটি সংস্কৃত ভাষায় কথা সারিৎসাগরের অন্তর্গত। সোমদেব ভট্টের কথা সারিৎসাগর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রচলিত হিন্দি অনুবাদ ‘বৈতালপচ্চিসী’র অংশবিশেষ পরিমার্জন করে ১৮৪৭ সালে বিদ্যাসাগর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ প্রকাশ করেন। তবে পাঠ্য বিষয়ক ও অনুবাদকর্ম হলেও বেতালপঞ্চবিংশতির মাধ্যমেই বিদ্যাসাগরের গদ্যশৈলী ও গদ্যসৌন্দর্য সম্পর্কে পাঠক প্রথম পরিচিত হন। উপক্রমনিকা ছাড়া গ্রন্থটিতে পঁচিশটি পর্ব আছে। এ-পর্বগুলিতে রয়েছে পঁচিশটি উপাখ্যান।
গল্পগুলি বেতাল নামে এক অতিপ্রাকৃত শক্তি রাজা বিক্রমাদিত্যকে ধারাবাহিকভাবে শোনায়। উপাখ্যানগুলির বিভিন্ন চরিত্র কাল্পনিক হলেও এরা মানুষের প্রেম-প্রার্থনা-কাম-লোভ-অসূয়া-বাৎসল্য ইত্যাদি দ্বারা আলোড়িত। তাই পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্দেশ্য প্রধান হলেও এই গ্রন্থের সাহিত্যরসকেও অস্বীকার করা যায় না।
এছাড়া বেতালপঞ্চবিংশতির মাধ্যমে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্ত করেছেন। এই গ্রন্থের উপাখ্যানগুলো বলতে গিয়ে লেখক বাংলা গদ্যে প্রথম সার্থকভাবে বিরাম চিহ্নের প্রবর্তন ঘটিয়েছেন, ফলে বাক্যের মধ্যে পাঠক প্রয়োজনীয় বিরতি ও তালের সন্ধান পেল। কর্কশ গদ্যের স্থানে সুললিত সুখকর গদ্যের অনুভূতি সঞ্চারিত হলো বাঙালি পাঠকের মনে। রবীন্দ্রনাথও বিদ্যাসাগরের গদ্যে দেখতে পেয়েছেন ‘এক অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত’।
মূলত পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটানোর তাগিদে সৃষ্ট হলেও গ্রন্থটি বাংলা গদ্যের ঊষর যুগে সাহিত্যের উর্বরক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে পরবর্তী সাহিত্যিকদের। তাই ঐতিহাসিকভাবেই বাংলা গদ্যের ইতিহাসে বেতালপঞ্চবিংশতি গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে।
বেতালপঞ্চবিংশতি ছাড়া বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত অনুবাদ গ্রন্থ হলো শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’ অবলম্বনে রচিত ভ্রান্তিবিলাস। এ দুটি গ্রন্থ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাকর্ম হলো: বাংলার ইতিহাস, জীবনচরিত, বোধোদয়, উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ, ব্যাকরণ কৌমুদী, শকুন্তলা উপাখ্যান, বিধবাবিবাহ, বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ), কথামালা, আখ্যানমঞ্জরী ইত্যাদি।
উল্লিখিত গ্রন্থগুলো ছাড়া তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ মৌলিক রচনা হলো ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ যা সাধারণের কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়। বিদ্যাসাগর তাঁর সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছে একজন সুরুচিসম্পন্ন লেখক ও অনুপ্রেরণাদানকারী শিক্ষাব্রতী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। তাঁর হাতেই বাংলা গদ্য এক নতুন রূপ লাভ করে। তিনি স্বকীয়ভাবে এক নতুন রীতির প্রবর্তন করেন যা আধুনিক বাংলা গদ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। মূলত তিনিই বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার।
যেহেতু বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তকেই প্রকাশ পেয়েছে এবং বিশ শতকের প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত তাঁর গ্রন্থই সাধারণভাবে সকল সরকারি ও স্বদেশীয় বিদ্যালয়সমূহে চালু ছিল, সেহেতু কয়েক প্রজন্মের লেখক, আমলা ও পেশাজীবীগণ প্রত্যক্ষ ও স্থায়িভাবে তাঁর গদ্যরীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
সমালোচকদের মতে বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যসাহিত্যে নবযুগের সৃষ্টি করেন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অতীত ও বর্তমান কৌশলের চমৎকার সংশ্লেষণই ছিল তাঁর রীতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কারমনা দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সমাজ-ধর্মীয় চিন্তাচেতনায় দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহতকারী অন্যান্য অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাঁর অধিকাংশ সংস্কারমূলক চিন্তাভাবনা যেমন ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (দুই খণ্ড)’ এবং ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (দুই খণ্ড)’ এ দুটি বিখ্যাত গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে।
কারণ সে যুগে বহুবিবাহ, বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি তখন ধর্মীয়ভাবে খুব স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। বিদ্যসাগর সমাজের এই দুষ্ট ক্ষতসমূহ সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে চান নি। কৌশল হিসেবে তিনি তাঁর যুক্তির স্বপক্ষে বিভিন্ন শাস্ত্র ও প্রাচীন গ্রন্থ থেকে অসংখ্য উদাহরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে জনসাধারণের ওপর গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজ তাঁর প্রচেষ্টাকে ভালো চোখে দেখেনি।
এতদসত্ত্বেও তাঁর শাস্ত্রবচন ও বিদ্রূপাত্মক যুক্তি উক্ত সামাজিক প্রতিবন্ধকতার রক্ষকদের ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ করেছিল, যদিও তিনি অনেক রক্ষণশীল কর্তৃক মারাত্মকভাবে নিন্দিতও হয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তৎকালীন সরকারের মাধ্যমে বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করাতে সমর্থ হন, যা এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিধবাবিবাহ বৈধকরণে ১৮৫৬ সালের আইনের কার্যকারিতায় এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রহিতকরণ এবং বিধবাবিবাহে উৎসাহ প্রদানে ১৮৭২ সালের ‘সিভিল ম্যারেজ এ্যাক্ট’ এ বিদ্যাসাগরের প্রভূত অবদান রয়েছে।
তাঁর লেখা ও কার্যাবলি উক্ত বিষয়াবলির স্বপক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক সহায়তা করে। এসব কারণে বিদ্যাসাগর বাংলার নবজাগরণের এক শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে বিবেচিত হন। তৎকালীন পশ্চাৎপদ সমাজের অন্ধকারকে ভেদ করে বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার প্রসারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে ‘বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি তাঁর ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেন ভূস্বামী ও অন্যান্য স্বচ্ছল ব্যক্তিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহিত করার মাধ্যমে।
তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি জেলায় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় সহ অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বহু বছর আগেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারীকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে সমাজ অগ্রসর হতে পারবে না।
কিন্তু ১৮৫৮ সালের জুন মাসে জনশিক্ষা পরিচালকের এক চিঠি আসে, সেখানে জানানো হয় যে, নারীশিক্ষার অগ্রসরের জন্য সরকারি অর্থ সাহায্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর কিছুতেই এ-সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি।
স্কুলগুলো পরিচালনার জন্য বিদ্যাসাগর নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ যোগান দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, অর্থ প্রত্যাহারের চিঠির বিরুদ্ধে জনশিক্ষা দফতরে নিয়মিত আবেদনও করতে থাকেন। তাঁর একাধিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত সরকার কিছু অর্থ পুনরায় বরাদ্দ দেয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে ‘কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’ বিদ্যাসাগরের এক মহৎ কীর্তি। নিজস্ব মতাদর্শের ভিত্তিতে অনেক কষ্টে উপার্জিত অর্থে ১৮৬৪ সালে তিনি এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনসায়াহ্নে এটিকে তিনি একটি আদর্শ কলেজে রূপান্তরিত করেন। বর্তমানে এটি বিদ্যাসাগর কলেজ নামে সুপরিচিত।
শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান অসাধারণ। প্রচলিত ধারার পরিবর্তে শিশুশিক্ষায় তিনি প্রবর্তন করেন আধুনিক চেতনার বিজ্ঞান ও প্রকৃতি-মনস্কতা। যাতে শৈশব থেকেই শিশু ও বালক-বালিকাদের মন যুক্তিবাদী চেতনায় গড়ে উঠতে পারে। শিশু শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি রচনা করেন যগান্তকারী শিশুপাঠ্য ‘বর্ণপরিচয়’।
বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে যতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ব্যবহার করেছেন; দ্বিতীয় ভাগে এগুলোর পাশাপাশি আশ্চর্যচিহ্নও আছে; কিন্তু কোনো ভাগেই তিনি জিজ্ঞাসাচিহ্ন ব্যবহার করেননি। ভাষা-শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় তিনি আরোহী পদ্ধতিকে উপযুক্ত মনে করেছেন। বর্ণ থেকে শব্দের পর্যায়ে গিয়েছেন; এরপর পাঠে শব্দগুচ্ছ বা বর্গ, ছোট বাক্য, বড় বাক্য এবং অনুচ্ছেদ এনেছেন; শেষে একাধিক অনুচ্ছেদ সহযোগে দীর্ঘ পাঠ তৈরি করেছেন।
বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের সব শব্দই যুক্তাক্ষরবিহীন; অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগের মূল লক্ষ্য যুক্তাক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাংলাভাষী শিশুর মাতৃভাষা শেখার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হিসেবে বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতিকে মেনে নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজবোধ্য করে তোলেন।
পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সুবিদিত। ‘সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা’, ‘তত্ত্বাবোধিনী পত্রিকা’, ‘সোমপ্রকাশ’ ও ইংরেজি ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ এর মতো পত্রিকাসমূহ তৎকালীন বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বিদ্যাসাগর এসব পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে এই অধ্যায়ের ওতপ্রোত সহচর হন।
দানশীলতার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের খ্যাতি এতটাই যে লোকে তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ বা করুণাসাগর বলত। আর্ত-পীড়িত-দরিদ্র কখনোই তাঁর দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফেরেনি। এমনকি কবি ও শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন উদার। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কের বিষয়টি এর অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ। এই মহাপুরুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্রের প্রধান গৌরব ছিল তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার আশ্চর্য মনুষ্যত্ব।”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, প্রতিভা ও বৈদগ্ধ্যে তিনি ছিলেন প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মোদমে ইংরেজদের মতো এবং হৃদয়বত্তায় বাঙালি জননীর মতো। একটি ঐতিহাসিক ও রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও বিদ্যাসাগর কখনো প্রথাগত ধর্মসেবী মানুষ ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও ইহজাগতিকতায় বিশ্বাসী। তাঁর কাছে বড় ধর্ম ছিল মানবতা।
উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীদের অন্যতম বলে খ্যত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বহুমুখী প্রতিভা দ্বারা সমাজ-সংস্কারসহ শিক্ষাক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন। শিক্ষাবিদ, সংস্কারক, লেখক ও মানবতাবাদী হিসেবে তিনি এত বড় মাপের একজন ব্যক্তি ছিলেন যে, ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই তাঁর মৃত্যুতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিল।
সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহে শোকসংবাদ এবং তাঁর কর্মের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ কবি ও লেখক বিদ্যাসাগর স্মরণে কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন।
এভাবে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা অর্জনের ফলে বিদ্যাসাগর সে শতকের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেই মূল্যায়ন অদ্যাবধি বিদ্যমান। এ-বছর, ২০২০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। তাঁর অনন্য জীবনদৃষ্টি এবং অসাধারণ কর্মসাধনার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এপার-ওপার বাংলায় বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হচ্ছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?






