সূরা আল-বালাদের তাফসীর

আজকে আমরা আপনাদের জানাবো সূরা আল বালাদ এর তাফসীর সম্পর্কে। সূরা আল বালাদ নাযিল হওয়ার সময় কাল। সূরা আল বালাদের বিষয়বস্তু। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।

অগাস্ট 17, 2023 - 10:00
অগাস্ট 17, 2023 - 21:35
 0
সূরা আল-বালাদের তাফসীর
সূরা আল-বালাদের তাফসীর | Image Source: Unsplash

নাম: পয়লা আয়াতের বালাদ শব্দ দিয়েই এ সূরাটির নাম রাখা হয়েছে। যখন নাযিলের সময় ও পরিবেশ ও সূরার বক্তব্য থেকে মনে হয় যে, এ সূরাটিও মাক্কী যুগের প্রথম ভাগের সূরা। কিন্তু একটি কথা থেকে বুঝা যায় যে, ঐ সময় এ সূরাটি নাযিল হয়, বিরোধীরা রাসূল (সা.)-এর উপর যুলুম চালাচ্ছিল।

আলোচ্য বিষয়: কুরআন পাকের এটা একটা মু'জিযা যে, একটা বিরাট বিষয় এ সূরায় ছোট ছোট কতক আয়াতে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এ দুনিয়ায় মানুষের স্থান কোথায়, মানুষের কাছে দুনিয়ারই বা স্থান কী, তা এখানে বুঝানো হয়েছে


আলোচনার ধারা

 . সূরাটি লা উকসিমু দিয়ে শুরু করা হয়েছে। সূরা কিয়ামাহও (৭৫নং সূরা) একইভাবে শুরু হয়েছে। লা অর্থ না। উকসিমু মানে, আমি কসম করে বলছি। এভাবে বললে বুঝা যায় যে, কোন কথাবার্তা চলছিলো, যার প্রতিবাদে কসম করে বলা হচ্ছে যে, তোমরা যা বলছ, তা কখনো ঠিক নয়, বরং আমি অমুক জিনিসের কসম করে বলছি যে, আসল কথা এই। এখন প্রশ্ন হলো যে, কাফিরদের গন্থটির প্রতিবাদ এখানে করা হয়েছে? পরবর্তী আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় যে, তারা বলতো যেআমরা যেভাবে জীবন কাটাচ্ছি এবং বাপ-দাদারাও যেভাবে কাটিয়ে গেছে, তাতে ভুল কোথায়? দুনিয়ায় যদ্দিন আছি খাব-দাব মজা করব, যতটা সম্ভব আরামে থাকার চেষ্টা করব। মওত আসলে মরে শেষ হয়ে যাব। পরকালের ধান্দায় জীবনটা নষ্ট করব কেন? এ কথার প্রতিবাদে পয়লা বলা হচ্ছে যে, তোমাদের এ ধারণা একেবারেই ভুল। এরপর এ আয়াতে এই শহরের কসম করছি বলে মাক্কা শহরের নামে কসম খাওয়া হয়েছে। 


দ্বিতীয় আয়াতে এ শহরেই রাসূল (সা.)- এর প্রতি যে অন্যায় করা হচ্ছে, সে কথা উল্লেখ করে তৃতীয় আয়াতে পিতা ও সন্তানের কসম করা হয়েছে। পিতা ও সন্তান মানে আদম (আ.) ও তাঁর সন্তান অর্থাৎ মানব জাতি। এসব কসম খেয়ে যে মহাসত্যকে তুলে ধরা হয়েছে, তা চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে। চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার জীবনটা মানুষের ভোগ ও আরামের উদ্দেশ্যে দেয়া হয় নি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অগণিত দুঃখ ও কষ্ট, দেহ ও মনের শ্রম, ক্লান্তি ও শান্তি এবং বহু উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে মানুষকে জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়েছে। দুনিয়ার জীবনটা ফুলের বিছানা নয়, কাঁটায় ভরা আখিরাতকে ভুলে দুনিয়ার মজায় লিপ্ত থাকাটা অতি বড় বোকামি।


এ দ্বারা দু
রকম বিরাট ক্ষতি হবে। একদিকে সে ভাল-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পরওয়া না করে দুনিয়ার জীবনে যে দুঃখ-কষ্ট পেল তার জন্য আখিরাতে কোন বদলা পাবে না। অথচ আল্লাহ পাক দুঃখ-কষ্টে ভরা দুনিয়ার জীবনে মানুষের জন্য যেটুকু আরাম ও সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন, সেটুকু যদি আল্লাহর দেয়া সীমার মধ্যে ভোগ করা হয়, তাহলে সে দুভাবে পরকালে লাভবান হবে। আল্লাহর মরযী মতো দুনিয়া ভোগ করার জন্যও পরকালে সে পুরস্কার পাবে, আর দুনিয়ার ছোট-বড় সব দুঃখ-কষ্টের বদলায় সেখানে অফুরন্ত নিয়ামাত পাবে


এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে
, কাফিরদের যে কথার প্রতিবাদ সূরার শুরুতে করা হয়েছে, তার সাথে মাক্কা শহর ও আদম সন্তানের কসম খাওয়ার সম্পর্ক কী? এ কসমের দ্বারা আল্লাহ পাক মাক্কাবাসীদেরকে বুঝাতে চান যে, সবাই যদি 'খাও-দাও মজা কর' নীতিতেই জীবন কাটাতো, তাহলে মানব জাতির মধ্যে কোন ভাল কাজই হতো না। তোমাদের এত শান্তির স্থান মাক্কা শহর কী তোমাদের মতো নাফসের গোলামদের দ্বারা কায়েম হতে পারতো? তোমরা তো ভালভাবেই জান যে, আল্লাহর এক নেক বান্দার বিরাট কুরবানী ও দুঃখ-কষ্টের ফলে এ মাক্কা সারা আরবে একমাত্র নিরাপদ ও শান্তির স্থানে পরিণত হয়েছে। আরবের সব জায়গায় তোমরা মারামারি-কাটাকাটি দেখতে পাচ্ছ। মাক্কা শহরে মানুষের উপর অন্যায় ও যুলুম করা দূরের কথা, জীব-জানোয়ার পর্যন্ত এখানে নিরাপদ। মাক্কার এ মর্যাদা কি এমনি হয়েছে? এর জন্যে ইবরাহীম (আ.), ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর মা'র কত বড় বড় ত্যাগ রয়েছে, তা কি তোমরা জানো না?


তেমনিভাবে তোমাদের বাপ আদমকেও বহু কষ্ট করে দুনিয়ায় আল্লাহর পছন্দনীয় জীবন যাপনের শিক্ষা নিতে হয়েছে। আদম সন্তানদের মধ্যে যারা এভাবে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করার যোগ্য, তারাই দুনিয়ায় মানুষের কল্যাণ করে যায়। তোমাদের মতো প্রবৃত্তির দাসদের চরিত্র এমন যে, মাক্কার নিরাপদ শহরে পর্যন্ত নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে অন্ধ হয়ে আল্লাহর রাসূলের উপর অত্যাচার করা জায়েয মনে করছো। অথচ তোমরা জানো যে, মুহাম্মদ (সা.) ঐ ইবরাহীম ও ইসমাঈলেরই বংশধর এবং তিনিও তাঁদের মতো একই মহান কাজে নিযুক্ত

 

. ৫-৭ আয়াতে নাফসের গোলামদের সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, এরা কি মনে করে যে, এদের উপর আর কোন শক্তি নেই? এরা যা ইচ্ছা তাই করতে থাকবে, আর এদেরকে পাকড়াও করার কেউ নেই বলেই তাদের ধারণা? এরা দুনিয়ায় নিজেদের বড়ত্ব প্রমাণ করার জন্য বাজে কাজে বহু টাকা-পয়সা খরচ করে এবং গর্ব করে বলে যে, “আমাদের সাথে কার তুলনা হয় ? আমরা অমুক অমুক কাজে কত সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়েছি।দুনিয়ায় এটুকু বাহাদুরী দেখাবার জন্যই এরা অন্যায়ভাবে মাল জমায় এবং খারাপ পথে তা উড়ায় ৭ম আয়াতে আবার আল্লাহ প্রশ্ন তুলে বলেন, “এরা কি মনে করে যে, এদের অন্যায় কামাই ও শয়তানী খরচের খবর আল্লাহর জানা নেই? এরা কিভাবে মাল জমা করেছে এবং কোন কোন কুপথে খরচ করেছে, তা কি দেখবার ও ধরবার কেউ নেই? সাথে সাথে পাকড়াও করা হচ্ছে না বলে কি একথা মনে করা ঠিক যে, কোন দিন ধরা হবেই না?”


৩. ৮-১১ আয়াতে আল্লাহ আবার জিজ্ঞেস করেছেন, “আমি কি মানুষকে সঠিক জ্ঞানের উপায় হিসাবে চোখ-মুখ দেই নি এবং এ সবের মারফতে বুঝবার শক্তি দেই নি, যার ফলে কোনটা ভাল আর কোন্টা মন্দ, তা সে জেনে নিতে পারে? বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে তার সামনে সুপথ, আমি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছি এক পথ মানুষকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে নিয়ে যায়। এ পথে যেতে নাফসের কোন বেগ পেতে হয় না, বরং নাফস খুব মজা পায়। আর এক পথ উন্নত চরিত্রের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু এ পথ কঠিন। এ পথে চলতে হলে নাফসকে জোর করে দমিয়ে রাখতে হয়। এটাই মানুষের দুর্বলতা যে, সে সুপথকে কঠিন দেখে কুপথে চলাই সহজ মনে করে


. ১২-১৬ আয়াতে একটি উদাহরণ দিয়ে সুপথে চলার বাধা কোথায়, তা বুঝানো হয়েছে। এ বাধাকে 'আকাবা' বলা হয়েছে। আকাবা ঐ কঠিন পথকে বলা হয়, যা পাহাড় ডিংগিয়ে যেতে হয়। আল্লাহর দেখানো সুপথকে এখানে পাহাড়ী পথের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে যে, ঐ উন্নতির পথে যেতে হলে লোক-দেখানো খরচ (রিয়া), গর্বের উদ্দেশ্যে খরচ ও বাহাদুরী দেখাবার জন্য খরচ না করে নিজের মাল ইয়াতীম ও মিসকীনদের জন্য খরচ করতে হবে কিন্তু যারা নাফসের খাহেশ মিটাবার উদ্দেশ্যে দেদার টাকা-পয়সা খরচ করে, তারা বিপদগ্রস্ত ও দুঃখী মানুষের উপকারে খরচ করতে চায় না। এখানেও তারা নাফস ও শয়তানের বাধা ডিংগাতে পারে না


৫. ১৭-২০ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা নাফস ও শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, তারা ঐ বাধা ডিংগিয়ে ইয়াতীম, মিসকীন ও দুঃস্থদের সাহায্য করে এবং ঈমানদারদের সাথে ইসলামী আন্দোলনে শরীক হয়। তারা সুসংগঠিত উপায়ে সমাজকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যে একে অপরকে ধৈর্যের সাথে আন্দোলনে অগ্রসর হবার জন্য এবং জনগণের প্রতি দরদ নিয়ে কাজ করার জন্য উৎসাহ দেয়। যারা এ পথে চলে, তারাই আল্লাহর রহমত লাভ করে। আর যারা বিপরীত পথ ধরে, দোযখের আগুনই তাদের পরিণাম। তারা সে আগুনেই ঘেরাও হয়ে থাকবে, তা থেকে পালাতে পারবে না


বিশেষ শিক্ষা

মানব-জীবন ত্যাগের মাধ্যমেই সার্থক হয়, ভোগের মাধ্যমে নয় ভোগের মধ্যে যে মজা, তা স্থায়ী তৃপ্তি দেয় না। ত্যাগের পথ কঠিন হলেও তাতেই স্থায়ী তৃপ্তি রয়েছে। ভোগের দ্বারা যোগ্যতা কমে, আর ত্যাগের দ্বারাই যোগ্যতা বাড়ে। যে কোন সাধনাই ত্যাগ দাবী করে। ভোগে মত্ত থাকলে কোন সাধনা করারই যোগ্যতা থাকে না উচ্চ ডিগ্রী এবং উজ্জ্বল সাফল্য তাদের ভাগ্যেই জুটে, যারা রাত-দিন পরিশ্রম করে আরামকে ত্যাগ করতে পেরেছে। সন্তানদেরকে সত্যিকার মানুষ করা ও যোগ্য বানাবার গৌরব সে-ই লাভ করতে পারে, যে তাদের প্রয়োজনে নিজের অনেক আরাম-আয়েশকে ত্যাগ করে প্রয়োজনীয় খরচ যোগায়। দেশের কল্যাণ তাদের দ্বারাই সম্ভব হয়, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়


ইতিহাসে তাদেরই গৌরব গাঁথা লেখা হয়, যারা ত্যাগের পথে মানব জাতির খিদমত করে। ত্যাগই হলো মনুষ্যত্বের পথ। ভোগ অবশ্যই পশুত্বের পরিচয় বহন করে দুনিয়ায় কাজের যোগ্য থাকার জন্য যতটুকু ভোগের দরকার, আল্লাহ ততটুকু ভোগকেইবাদাতবলে গণ্য করেছেন । আল্লাহর দেয়া সীমা লংঘন করে ভোগ করাই হলো পশুত্ব তাফহীমুল কুরআন সারসংক্ষেপ আমপারার তাফসীর অনুবাদ অধ্যাপক গোলাম আযম।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

মোঃ মোবাশ্বের আলম কোরবান আমি একজন ইসলামিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।