যে বাঘকেও পরাজিত করেছিল, তার নাম শ্যামাকান্ত

আমাদের এই উপমহাদেশ বিশেষ করে আমাদের এই বাংলাদেশ ইতিহাসের অনেক বীর সন্তানদের জন্মদাত্রী। সেই বীরদের মধ্যেই শ্যামাকান্ত নামের একজন ছিলেন যিনি বনের হিংস্র পশু বাঘের সাথে অবলীলায় লড়াই করতেন এবং কখনো পরাজয় বরণ করেননি।

জুল 4, 2023 - 16:00
জুল 4, 2023 - 15:33
 0
যে বাঘকেও পরাজিত করেছিল, তার নাম শ্যামাকান্ত
যে বাঘকেও পরাজিত করেছিল, তার নাম শ্যামাকান্ত

আমরা আজকে জানবো আমাদের এই বাংলাদেশের এমন এক বীরের কথা যিনি কুস্তি বিদ্যায় এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে কোন প্রকার অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি হাতে বনের হিংস্র পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে যুদ্ধ করে সেই হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার কে বেমালুম পরাজিত করেছিলেন। বাঘের মতো হিংস্র জানোয়ারকে নিজের শরীরের শক্তি দ্বারা বসে এনেছিলেন যিনি।


এই মহান বীরের নাম শ্যামাকান্ত। যদি কোনো মানুষের অদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকে এবং সে যদি
পরিশ্রম করতে ভয় না পায় তবে এই পৃথিবীর সকল শক্তিকে যে তার পক্ষে বসে আনা সম্ভব তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন এই উপমহাদেশের কৃতি সন্তান শ্যামাকান্ত।


কিছু মাসের কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে
, নিজের শরীরের বহু রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে সফল হন তিনি। বাঘের সাথে লড়াইয়ের সময় শ্যামাকান্ত বাঘের মুখে তার হাতটি ঢুকিয়ে দিতেন। বাঘ তার হাতটিকে কামড়ে ধরলে রক্তের প্রবাহ ঝড়ে পড়তো, কিন্তু তিনি থাকতেন শান্ত।


বাঘের খাঁচার ভিতর ঢুকে বাঘের সাথে লড়াই করার সময় বহুবার তিনি বাঘের হিংস্র আক্রমণের
শিকার হয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি নিজেকে শান্ত রেখে, নিজের কৌশল প্রয়োগ করে হিংস্র পশুকে পরাজিত করে নিরাপদে বেড়িয়ে আসেছেন। এভাবেই হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তি। তাঁর এই অসীম বীরত্বের কারনে তার নামই হয়ে যায় – ব্যাঘ্রবীর শ্যামাকান্ত!



কী এই
ব্যাঘ্রবীর শ্যামাকান্তর পরিচয়?

এই বীরের আসল নাম শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম সাল ১৮৫৮। অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলের আড়িয়ল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শ্যামাকান্তর পিতা শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিপুরা জেলার মুরাদনগরে আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। শ্যামাকান্তর বাবার ছিল চারজন ছেলে সন্তান ও তিনজন মেয়ে সন্তান।


চার ভাইয়ের মধ্যে শ্যামাকান্ত ছিলেন সবার বড়। বাঙালি জাতি ভীরু
, দুর্বল, কাপুরুষ, আত্মরক্ষায় অক্ষম - এই অপবাদ ঘোচানোর উদ্যমে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাঁর শক্তি এবং সাহস ছিল অপরিসীম। ছোট থেকেই পড়াশোনার চাইতে শরীরচর্চার উপর তার ঝোঁক ছিল বেশি।


পড়াশোনা করেছেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে সেখানে তাঁর একজন সহপাঠী ছিলেন পরেশনাথ ঘোষ।
দুজনে মিলে প্রথমে লক্ষ্মীবাজারের অধর ঘোষের আখড়ায় কুস্তি অনুশীলন করা শুরু করেছিলেনকথিত আছে তাঁরা দুই মণ দুধের মালাই খেতেন। কুস্তিতে ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন ব্যাঘ্রবীর শ্যামাকান্ত। অবলীলায় হারাতেন তৎকালীন পালোয়ানদের


শ্যামাকান্ত ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে সৈনিক হবেন। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে বাঙালিরা তখন নিষিদ্ধ ছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন রাজ্যের আঞ্চলিক সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সৈনিক হওয়ার সাধ পূরণ করবেন। এর মধ্যেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। যার ফলে তার সৈনিক হওয়ার সাধ অধরাই থেকে যায়।


বিবাহের পর শ্যামাকান্ত আগরতলায় বেড়াতে যান
ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর শ্যামাকান্তের দেহ কাঠামো ও শারীরিক সক্ষমতা দেখে তাকে নিজের নিরাপত্তা বাহিনীতে যুক্ত করেন। একবার মহারাজের সাথে শিকারে বেরিয়েছিলেন তিনি। শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন তারা। সেইসময় খালি হাতে বাঘের সাথে লড়াই করে সেই বাঘকে ধরাশায়ী করেছিলেন শ্যামাকান্ত


দুই বছর ত্রিপুরায় থাকার পর ১৮৭৬ সালে শ্যামাকান্ত বরিশাল জেলা স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষকের
চাকরি নিয়ে বরিশাল চলে যান। সেখানে গঠন করেন একটি সার্কাস দল এবং কেনেন একটি চিতাবাঘ। সেই চিতাবাঘকে বশে আনার জন্যে খাঁচার ভেতর ঢুকে সেই বাঘের সাথে রীতিমত লড়াই শুরু করে দিতেন শ্যামাকান্ত।


বাঘের আঘাতে বহুবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি তিনি। দুইমাস পর সেই
চিতাবাঘ তাঁর বশ মানে। এরপর ধীরে ধীরে বাঘ, সিংহের মত হিংস্র পশু নিজের বশে আনতে শুরু করেন তিনি। সারা দেশ ও দেশের গন্ডি পেরিয়ে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে শ্যামাকান্তর।


ভাওয়াল অঞ্চলের তৎকালীন রাজা তাকে সুন্দরবনের একটি রয়াল বেঙ্গল টাইগার উপহার দেন।
শ্যামাকান্ত সেই বাঘটির নাম রেখেছিলেন গোপাল। ট্রেনে করে বাঘটাকে ঢাকায় নিয়ে বন্ধু পরেশনাথ ঘোষের আখড়ার শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। এই বাঘটিকেও বশে নিয়ে এনেছিলেন তিনি। বহুবার তাঁর হাত কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল বাঘটি কিন্তু পরাজয় মানেননি এই ব্যাঘ্রবীর।


পাটনার তখনকার নবাব শ্যামাকান্তকে বাঘিনীর সাথে কুস্তি লড়ার আহ্বান জানান। কুস্তিতে জিততে
পারলে পুরস্কার ছিল দুই হাজার টাকা। শ্যামাকান্ত এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। চারিদিকে কোলাহল পড়ে যায়। কয়েক হাজার লোক সেই প্রতিযোগিতা দেখতে আসে। সেই বাঘিনীটিকে লড়াইয়ে পরাজিত করেন বিজয়ের মালা গলায় পড়েন শ্যামাকান্ত


নবাবের থেকে তৎকালীন ২ হাজার টাকা
, ২টি আরব ঘোড়া ও ঐ বাঘিনী উপহার পান এই ব্যাঘ্রবীর ১৮৯৪ সালে শ্যামাকান্ত ফ্রেডকুকের ইংলিশ সার্কাসে বাঘের খেলা দেখাতে শুরু করেন। বিনিময়ে পেতেন মোটা অংকের বেতন মাসে ১৫০০ টাকা পেতেন যা তখনকার হিসেবে অনেক মোটা অংকের বেতন। এক বছর পর তিনি ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের সার্কাস দল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখাতে শুরু করেন সারা বাংলায় হইচই পড়ে যায়।


প্রায় ১৮ বছর বাঘ সিংহের খেলা দেখিয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল রয়্যাল বেঙ্গল
টাইগারের সঙ্গে তাঁর খেলা। রয়্যাল বেঙ্গলের টাইগারের খাঁচায় ঢুকতেন তিনি আর তখনই প্রবল গর্জন করে ছুটে আসত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আর সাথে সাথে বাঘের মুখে ডান হাত ঢুকিয়ে রয়্যাল বেঙ্গলকে আলিঙ্গন করতেন শ্যামাকান্ত। এই দৃশ্য দেখে দর্শকদের কেউ হতো যারপরনাই আতঙ্কিত আবার কেউ হতবিহ্বল।


নিজের বুকের উপর বিশাল পাথর রেখে খেলা দেখাতে পারতেন শ্যামাকান্ত। দশ মন ওজনের পাথর বুকের উপর বহন করতে পারতেন তিনি। একবার বড়লাটের প্রাসাদে ১৪ মন ওজনের পাথর বুকে
বহন করেছিলেন তিনি। তার বীরত্বের কথা একটি আর্টিকেলে লিখে শেষ করার মত নয়।


১৮ বছর খেলা দেখানোর পর ত্রিপুরার ল্যাংটা বাবা নামক জনৈক প্রবীণ সন্ন্যাসীর সাথে
শ্যামাকান্তের পরিচয় হয় তার সান্নিধ্যে এসে শ্যামাকান্ত স্ত্রী কন্যাকে ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। এছাড়া তিব্বতীবাবা নামক এক গুরুর কাছে শ্যামাকান্তকে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস জীবনে তার নাম রাখা হয় সোহং স্বামী। সন্ন্যাস গ্রহণের পর ধ্যান সাধনা শুরু করেন সোহং স্বামী। তারপরে তিব্বতীবাবার নির্দেশে নৈনিতাল থেকে সাত মাইল দূরে হিমালয়ের বুকে ভাওয়ালী নামক স্থানে তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেই সাধনায় মগ্ন থাকতেন তিনি। এবং ঐ সময় একটি বই লিখেছিলেন তিনি।


১৯১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন 
ব্যাঘ্রবীর শ্যামাকান্ত ওরফে সোহং স্বামী। গুরু তিব্বতীবাবা তার দেহাবশেষ বর্ধমান জেলার পালিতপুর আশ্রমে নিয়ে আসেন ও সেখানে তাঁর সমাধি স্থাপন করেন।


সত্যিই গর্বে বুকটা ভরে উঠে যখন জানতে পারি শ্যামাকান্তের মতো মহান বীরেরা আমাদেরই
পূর্বপুরুষ এবং তারাও এই মাটিরই সন্তান।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

Abdus Sadik Content Writer