‘জুলভার্ন’, একজন দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা
জুল ভার্নের কল্পনায় যেনো আজকের বাস্তব বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। যুগের চেয়েও অনেক যুগ এগিয়ে থাকা মানুষ একজন মানুষের নাম জুল ভার্ন। আসলে তাকে কোনো বিশেষনেই বিশেষায়িত করা যায় না। কারণ তার প্রতিটা লেখাই এক বিস্ময়।

বিজ্ঞানের যে সকল আবিষ্কার নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি সেই গর্বের বস্তু গুলোতে চড়ে তার গল্পের নায়কেরা সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, তার বাস্তোবিক প্রয়োগও করেছে। উড়োজাহাজ, রকেট, সাবমেরিনের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগ, মহাকাশ ভ্রমণ ও সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণ, বেলুনে ভ্রমন, মেট্রো রেল ভ্রমণ সকিছুই জেন ছিল তার হাতের খেলনা। এই সব ভ্রমনে তিনি যা দেখেছেন যা বর্ণনা করেছেন তাও আজ প্রায় সবই বাস্তব।
পাতাল অভিযান, মেরু অভিযান, শুকনা মরুভূমিতে শহর গড়া সব খানেই তার অবাধ বিচরণ। টেলিফোনে কথা বলা এমন কি ভিডিও কনফারেন্স এ কথা বলেছে তার গল্পের নায়কেরা তার চেয়েও বড় বিস্ময় হলো তিনি যখন এই ভাবে কল্পনার জগতে তার নায়কদের ঘিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন ইচ্ছে মত, সেই সময় প্রায় ৪০ বছরের অধিক কাল তিনি এক চিলে কোঠাই প্রায় বন্দী জীবন-যাপন করতেন।
জুলভার্ন এর জন্ম
অপ্রতিদ্বন্দ্বী কল্পবিজ্ঞান এর এই লেখক কে অনেকেই কল্পবিজ্ঞানের জনকও বলে থাকেন। তার বর্নিত ১০৮ টি যন্ত্রের ৬৪ টি বাস্তবে রুপ পেয়েছে।
জুলভার্নের শৈশবকাল
তাই সে ও যায় আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে প্যারিসে। প্যারিসে গিয়ে জুল ভার্নের সাহিত্যপ্রেমে দোলা লাগে। আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে বেশ প্রসারও লাভ করেন। কিন্তু খুব দ্রুত এ পেশার প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন এবং ১৮৬৭ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায় আইন ব্যবসা ছেড়ে।
জুলভার্নের লেখার প্রতি অনুপ্রেরণা
তাঁর দৃঢ় এমন বিশ্বাস ছিল যে, কিংবদন্তি চরিত্র ‘রবিনসন ক্রুসো’র মতই ‘নিরাশার দ্বীপ’ থেকে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামী হঠাৎ একদিন ফিরে আসবেই তাঁর কাছে। শিক্ষিকার এমন আশাবাঞ্জক কথাগুলি জুল ভার্নের মনের গভীরে ছাপ ফেলে।
এই ছাপ এতটাই গভীর ছিল যে, The Mysterious Island, Second Fatherland, The School for Robinsons সহ, তাঁর লেখা বহু উপন্যাসে সেই সাহিত্যধারাকে আমরা বার বার ফিরে আসতে দেখেছি।
১৮৩৬ সালে জুল ভার্নের পিতা পিয়ের ভার্ন অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে লোয়ার নদীর তীরবর্তী সঁৎনে গ্রামে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। নদীর প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ। তাকে এই নদীর বুকে ভেসে যাওয়া পাল তোলা জাহাজগুলি তাঁর ফেরারি মনকে রাঙ্গিয়ে দিতো এক অলীক কল্পনার মায়াবী জগতে।
এছাড়া ছেলেবেলায় তিনি বহুবার তিনি গেছেন পাশের শহরে মামার বাড়ী। মামা প্রুইদঁ অ্যালোট ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জাহাজের নাবিক। তার কাছে সারা বিশ্ব ভ্রমণ কাহিনী শুনে কেটেছে কত দুপুর, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
তাঁর বহু কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসে মামার কাছ থেকে শোনা ভ্রমণকাহিনিগুলি অমরত্ব লাভ করেছে বলে অনেকে ধারনা করেন। ১৮৩৯ সালে ১১ বছর বয়সে গোপনে ইন্ডিজ পালিয়ে যেতে চেয়েছিল ‘Coralie’ নামে এক জাহাজের কেবিন-বয়ের চাকরি নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল ২টি বিদেশ ভ্রমণ, বোন ক্যারোলিনকে প্রবালের কন্ঠহার উপহার দেবে।
কিন্তু ধরা পড়ে যান পিতার কাছে। স্বভাবতই দুঃখে ক্ষোভে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এবার ভ্রমণ করবেন ‘শুধু কল্পনার রাজ্যে’ তাও কেবল কাগজে-কলমে। তাই বোর্ডিং স্কুলে থাকাকালেই জুল ভার্ন শুরু করেন ছোট গল্প ও কবিতা লেখা। আর এভাবেই শুরু হয় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথে তাঁর যাত্রা।
সাহিত্যে জুলভার্ন
১৮৫৬ সালে জুল ভার্ন অনরাইন দি ভিয়েনার নামক এক বিধবার সাথে হৃদয়ের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। তার দু’টি মেয়েও ছিল। তবু ১৮৫৭ সালে তারা বিয়ে করেন এবং দুই মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব নেন জুল ভার্ন। বাড়তি পরিবারের জন্য প্রয়োজন পড়ে বাড়তি রোজগারেরও, স্টোকব্রোকার হিসেবে নুতুন কাজ শুরু করলেও কখনোই তিনি তার সাহিত্যচর্চা ছাড়েন নি।
তার লেখনীতে ব্যাপক উৎসাহ তৈরী হয় যখন ১৮৫৯ সালে তিনি অনরাইন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে জাহাজযাত্রায় যোগ দেন। ১৮৬১ সালে তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান মাইকেল ভার্নের জন্ম হয়।
প্রথম বই প্রকাশের গল্প
দাউ দাউ আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে সাধের প্রথম উপন্যাসটি। সেই সাথে মৃত্যু ঘটছে এক লেখক সত্ত্বারও। করুণ চোখে সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখছেন জুল ভার্ন নিজেই। মনে এক নিদারুন আবেগ আর কোনো দিন লিখবেন না তিনি।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সব সময়ই ভিন্ন। ঘটনা বুঝতে পেরে ঝড়ের বেগে কোথা থেকে ছুটে এল এক নারী। লেলিহান শিখা থেকে পাণ্ডুলিপিটি তুলে নিলেন। ঝটপট আগুন নিভিয়ে দিলেন। সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেল বিখ্যাত একটি লেখা। সেই নারী আর কেউ নন তারই স্ত্রী।
এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। লেখকের স্ত্রী নিজেই এক প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাপার ব্যবস্থা করলেন পাণ্ডুলিপিটি। ১৮৬৩ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে ফারসি ভাষায় প্রকাশিত হলো ‘কিংক সিমেইনস এন বেলুন’ নামে বইটি।
পরে ইংরেজিতে অনুবাদ হয় ‘ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন’ (বাংলায় বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ) শিরোনামে। দুঃসাহসী অভিযানের সেই উপন্যাস টির মাধ্যমেই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেলো।
কারণ সেই সময় তিনি পৃথিবীর এমন কিছু বিবরন দেন যা সেই সময়ের পরিবেশে কারো পক্ষেই জানা সম্ভব ছিলো না। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাকে। জেনে রাখা ভালো যে, এই বইয়েরই সিক্যুয়েল হিসেবে আমরা পেয়েছি আরেক জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’। এই বই এই দেখা পাই আমরা ক্যাপ্টেন নিমো আর হার্ডিংয়ের, দেখা পাই কাল্পনিক ডুবোজাহাজ নটিলাসের।
জুলভার্নের কিছু জাদুকরি বই
১৮৬৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘Five Weeks in a Balloon’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর প্রকাশক পিয়ের-জুল হ্যাটজেলের সহযোগিতায় লিখেন নিখুঁত গবেষণালব্ধ কল্পবিজ্ঞাননির্ভর অভিযান এর নামকরণ করা হয় ‘Voyages Extraordinaires’ অর্থাৎ অসাধারণ ভ্রমণ।
তাঁর আশ্চর্য কলমের জাদুকরী ছোঁয়ায় যে সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল তা কল্পবিজ্ঞানের জগতে ইতিহাসই সৃষ্টি করেনি জুল ভার্ন কেও করেছে অমর। ১৮৬৩ সাল থেকে ১৯০৫ সাল এই ৪২ বছরে ‘Voyages Extraordinaires’ মূল শিরোনামের অধীনে তিনি ধারাবাহিকভাবে চুয়ান্নটি অসাধারণ কল্পবিজ্ঞাননির্ভর অভিযান কাহিনি লিখেছিলেন।
তিনি ফরাসি ভাষায় লিখলেও বেশিরভাগ বই ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে।
ইংরেজিতে অনুদিত উল্লেখযোগ্য বই সমূহ
দি অ্যাডভেঞ্চার অফ ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস, অ্যারাউন্ড দা মুন, দা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ, ইন টু দ্য নাইজার ব্যান্ড, এন এন্টার্টিক মিস্ট্রি, সিটি ইন দ্য সাহারা, টাইগার্স এন্ড ট্রেইটর্স প্রভৃতি। বাংলাদেশের সেবা প্রকাশনি থেকে তার অনেক গুলো বই এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যে কেউ কালেকশন করে পড়তে পারেন এই অমর বই গুলো।
পরিশেষ
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?






