‘জুলভার্ন’, একজন দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা

জুল ভার্নের কল্পনায় যেনো আজকের বাস্তব বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। যুগের চেয়েও অনেক যুগ এগিয়ে থাকা মানুষ একজন মানুষের নাম জুল ভার্ন। আসলে তাকে কোনো বিশেষনেই বিশেষায়িত করা যায় না। কারণ তার প্রতিটা লেখাই এক বিস্ময়।

মার্চ 19, 2023 - 17:00
মার্চ 19, 2023 - 15:53
 0
‘জুলভার্ন’, একজন দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা
জুলভার্ন: একজন দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা | Image Credit: Linternaute.com

বিজ্ঞানের যে সকল আবিষ্কার নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি সেই গর্বের বস্তু গুলোতে চড়ে তার গল্পের নায়কেরা সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, তার বাস্তোবিক প্রয়োগও করেছে। উড়োজাহাজ, রকেট, সাবমেরিনের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগ, মহাকাশ ভ্রমণ ও সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণ, বেলুনে ভ্রমন, মেট্রো রেল ভ্রমণ সকিছুই জেন ছিল তার হাতের খেলনা। এই সব ভ্রমনে তিনি যা দেখেছেন যা বর্ণনা করেছেন তাও আজ প্রায় সবই বাস্তব।


পাতাল অভিযান, মেরু অভিযান, শুকনা মরুভূমিতে শহর গড়া সব খানেই তার অবাধ বিচর টেলিফোনে কথা বলা এমন কি ভিডিও কনফারেন্স এ কথা বলেছে তার গল্পের নায়কেরা তার চেয়েও বড় বিস্ময় হলো তিনি যখন এই ভাবে কল্পনার জগতে তার নায়কদের ঘিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন ইচ্ছে মত, সেই সময় প্রায় ৪০ বছরের অধিক কাল তিনি এক চিলে কোঠাই প্রায় বন্দী জীবন-যাপন করতেন।


জুলভার্ন এর জন্ম

পুরোনাম জুল গাব্রিয়েল ভার্ন (Jules Gabriel Verne)। তার জন্ম ১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এবং মৃত্যু ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ। তিনি একজন ফরাসি লেখক হিসেবে পরিচিত এবং অসামান্য সব বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী রচনার জন্যও তিনি বিখ্যাত। তিনি কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে ভেসে বেড়াতেন। তবে তিনি তার কল্পনাকে শুধু নিজের মধ্যেই নিজের জন্য সীমাবদ্ধ রাখেননি, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন কল্প-বিজ্ঞান প্রেমীদের কাছে।


অপ্রতিদ্বন্দ্বী কল্পবিজ্ঞান এর এই লেখক কে অনেকেই কল্পবিজ্ঞানের জনকও বলে থাকেন। তার বর্নিত ১০৮ টি যন্ত্রের ৬৪ টি বাস্তবে রুপ পেয়েছে।


জুলভার্নের শৈশবকাল

ফ্রান্সের পশ্চিমে বিস্কে উপসাগরের তীরের নঁত নামের এক বন্দর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জুল ভার্নের পিতা পিয়েরে ভার্ন ও মা সোফি এলো দে লা ফুয়ে। পিতা ছিলেন সেখানকার নামকরা আইনজীবী। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হবার কারণে আইনজীবী পিতার ইচ্ছাপূরণের ভার বর্তায় জুল ভার্নের ওপরেই।


তাই সে ও যায় আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে প্যারিসে। প্যারিসে গিয়ে জুল ভার্নের সাহিত্যপ্রেমে দোলা লাগে। আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে বেশ প্রসারও লাভ করেন। কিন্তু খুব দ্রুত এ পেশার প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন এবং ১৮৬৭ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায় আইন ব্যবসা ছেড়ে।



জুলভার্নের লেখার প্রতি অনুপ্রেরণা

১৮৩৪ সালে, নঁতে শহরের বোর্ডিং স্কুলে দেখা পান স্কুলের শিক্ষিকা ম্যাডাম স্যাম্বিনের। তার স্বামী, নৌবাহিনীর এক অধিনায়ক ছিলেন যিনি প্রায় ৩০ বছর আগে হারিয়ে গেছেন। ম্যাডাম স্যাম্বিন তাঁর ছাত্রদের প্রায়ই বলতেন, জাহাজডুবির ফলে হারিয়ে গেছে তাঁর স্বামী।


তাঁর দৃঢ় এমন বিশ্বাস ছিল যে, কিংবদন্তি চরিত্র ‘রবিনসন ক্রুসো’র মতই ‘নিরাশার দ্বীপ’ থেকে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামী হঠাৎ একদিন ফিরে আসবেই তাঁর কাছে। শিক্ষিকার এমন আশাবাঞ্জক কথাগুলি জুল ভার্নের মনের গভীরে ছাপ ফেলে।


এই ছাপ এতটাই গভীর ছিল যে, The Mysterious Island, Second Fatherland, The School for Robinsons সহ, তাঁর লেখা বহু উপন্যাসে সেই সাহিত্যধারাকে আমরা বার বার ফিরে আসতে দেখেছি।


১৮৩৬ সালে জুল ভার্নের পিতা পিয়ের ভার্ন অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে লোয়ার নদীর তীরবর্তী সঁৎনে গ্রামে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। নদীর প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ। তাকে এই নদীর বুকে ভেসে যাওয়া পাল তোলা জাহাজগুলি তাঁর ফেরারি মনকে রাঙ্গিয়ে দিতো এক অলীক কল্পনার মায়াবী জগতে।


এছাড়া ছেলেবেলায় তিনি বহুবার তিনি গেছেন পাশের শহরে মামার বাড়ী। মামা প্রুইদঁ অ্যালোট ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জাহাজের নাবিক। তার কাছে সারা বিশ্ব ভ্রমণ কাহিনী শুনে কেটেছে কত দুপুর, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।


তাঁর বহু কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসে মামার কাছ থেকে শোনা ভ্রমণকাহিনিগুলি অমরত্ব লাভ করেছে বলে অনেকে ধারনা করেন। ১৮৩৯ সালে ১১ বছর বয়সে গোপনে ইন্ডিজ পালিয়ে যেতে চেয়েছিল ‘Coralie’ নামে এক জাহাজের কেবিন-বয়ের চাকরি নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল ২টি বিদেশ ভ্রমণ, বোন ক্যারোলিনকে প্রবালের কন্ঠহার উপহার দেবে।


কিন্তু ধরা পড়ে যান পিতার কাছে। স্বভাবতই দুঃখে ক্ষোভে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এবার ভ্রমণ করবেন ‘শুধু কল্পনার রাজ্যে’ তাও কেবল কাগজে-কলমে। তাই বোর্ডিং স্কুলে থাকাকালেই জুল ভার্ন শুরু করেন ছোট গল্প ও কবিতা লেখা। আর এভাবেই শুরু হয় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথে তাঁর যাত্রা।



সাহিত্যে জুলভার্ন

মঞ্চনাটক এর রচয়িতা হিসেবে সাহিত্যাঙ্গনে জুল ভার্নের প্রবেশ ঘটে, তার প্রথম নাটকটি ছিল একটি একাঙ্কিকা - ‘ব্রোকেন স্ট্রোস’। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আইনের পেশাও চালিয়ে যান জুল ভার্ন। কিন্তু পারেনি জুল ভার্ন নিজের সাথে মিথ্যাচার করতে। ১৮৫২ সালে আইন ব্যবসা বাদ দিয়ে জুল ভার্ন ‘থিয়েটার লিরিক’ এ সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এখানে থাকাকালীন তিনি রচনা করেন ‘ব্লাইন্ড ম্যান’স ব্লাফ’ ও ‘দ্য কম্প্যানিয়নস অফ দ্য মার্জোলাইন’ এর মত বিশ্রুত নাটক।


১৮৫৬ সালে জুল ভার্ন অনরাইন দি ভিয়েনার নামক এক বিধবার সাথে হৃদয়ের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। তার দু’টি মেয়েও ছিল। তবু ১৮৫৭ সালে তারা বিয়ে করেন এবং দুই মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব নেন জুল ভার্ন। বাড়তি পরিবারের জন্য প্রয়োজন পড়ে বাড়তি রোজগারেরও, স্টোকব্রোকার হিসেবে নুতুন কাজ শুরু করলেও কখনোই তিনি তার সাহিত্যচর্চা ছাড়েন নি।


তার লেখনীতে ব্যাপক উৎসাহ তৈরী হয় যখন ১৮৫৯ সালে তিনি অনরাইন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে জাহাজযাত্রায় যোগ দেন। ১৮৬১ সালে তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান মাইকেল ভার্নের জন্ম হয়।


প্রথম বই প্রকাশের গল্প

রাগে-দুঃখে ক্ষোভে হতাশায় পুড়ছে তার মন। সামনে সর্বগ্রাসী আগুনের কুন্ডলী। পুড়িয়ে ফেলবেন তার এই পান্ডুলিপি। প্রথম উপন্যাস লেখার পর ঘুরেছেন প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু এমন উদ্ভট কল্প-কাহিনী কেউ ছাপতে রাজি নয়। ভেঙ্গে পড়েছে তার স্বপ্ন। একটু দীর্ঘশ্বাস তারপর সামান্য দ্বিধা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আগুনেই ছুড়লেন পাণ্ডুলিপিটি। এখন অপেক্ষা শুধু কিছু সময়ের।


দাউ দাউ আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে সাধের প্রথম উপন্যাসটি। সেই সাথে মৃত্যু ঘটছে এক লেখক সত্ত্বারও। করুণ চোখে সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখছেন জুল ভার্ন নিজেই। মনে এক নিদারুন আবেগ আর কোনো দিন লিখবেন না তিনি।


কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সব সময়ই ভিন্ন। ঘটনা বুঝতে পেরে ঝড়ের বেগে কোথা থেকে ছুটে এল এক নারী। লেলিহান শিখা থেকে পাণ্ডুলিপিটি তুলে নিলেন। ঝটপট আগুন নিভিয়ে দিলেন। সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেল বিখ্যাত একটি লেখা। সেই নারী আর কেউ নন তারই স্ত্রী।


এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। লেখকের স্ত্রী নিজেই এক প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাপার ব্যবস্থা করলেন পাণ্ডুলিপিটি। ১৮৬৩ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে ফারসি ভাষায় প্রকাশিত হলো ‘কিংক সিমেইনস এন বেলুন’ নামে বইটি।


পরে ইংরেজিতে অনুবাদ হয় ‘ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন’ (বাংলায় বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ) শিরোনামে। দুঃসাহসী অভিযানের সেই উপন্যাস টির মাধ্যমেই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেলো।


কারণ সেই সময় তিনি পৃথিবীর এমন কিছু বিবরন দেন যা সেই সময়ের পরিবেশে কারো পক্ষেই জানা সম্ভব ছিলো না। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাকে। জেনে রাখা ভালো যে, এই বইয়েরই সিক্যুয়েল হিসেবে আমরা পেয়েছি আরেক জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’। এই বই এই দেখা পাই আমরা ক্যাপ্টেন নিমো আর হার্ডিংয়ের, দেখা পাই কাল্পনিক ডুবোজাহাজ নটিলাসের।



জুলভার্নের কিছু জাদুকরি বই

১৮৬২ সালে প্রকাশক হ্যাটজেলের সাথে পরিচয় ছিল জুল ভার্নের জীবনের একটি অন্যরকম মোড়। হ্যাটজেল জুল ভার্নের লেখার সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা করেন ও তাকে আরো লিখতে উৎসাহ দেন এই প্রকাশক।


১৮৬৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘Five Weeks in a Balloon’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর প্রকাশক পিয়ের-জুল হ্যাটজেলের সহযোগিতায় লিখেন নিখুঁত গবেষণালব্ধ কল্পবিজ্ঞাননির্ভর অভিযান এর নামকরণ করা হয় ‘Voyages Extraordinaires’ অর্থাৎ অসাধারণ ভ্রমণ।


তাঁর আশ্চর্য কলমের জাদুকরী ছোঁয়ায় যে সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল তা কল্পবিজ্ঞানের জগতে ইতিহাসই সৃষ্টি করেনি জুল ভার্ন কেও করেছে অমর। ১৮৬৩ সাল থেকে ১৯০৫ সাল এই ৪২ বছরে ‘Voyages Extraordinaires’ মূল শিরোনামের অধীনে তিনি ধারাবাহিকভাবে চুয়ান্নটি অসাধারণ কল্পবিজ্ঞাননির্ভর অভিযান কাহিনি লিখেছিলেন।


তিনি ফরাসি ভাষায় লিখলেও বেশিরভাগ বই ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে।


ইংরেজিতে অনুদিত উল্লেখযোগ্য বই সমূহ

‘প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ (১৮৬০), ‘আ জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ’ (১৮৬৪), ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ (১৮৬৫), ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ (১৮৬৯), ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ (১৮৭৫), ‘মাইকেল স্ট্রগফ’ (১৮৭৫), ‘দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি’ (১৮৭৭) এবং ‘দ্য পারসেজ অব দ্য নর্থ পোল’ (১৮৮৮)।


দি অ্যাডভেঞ্চার অফ ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস, অ্যারাউন্ড দা মুন, দা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ, ইন টু দ্য নাইজার ব্যান্ড, এন এন্টার্টিক মিস্ট্রি, সিটি ইন দ্য সাহারা, টাইগার্স এন্ড ট্রেইটর্স প্রভৃতি। বাংলাদেশের সেবা প্রকাশনি থেকে তার অনেক গুলো বই এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যে কেউ কালেকশন করে পড়তে পারেন এই অমর বই গুলো।


পরিশেষ

জুল ভার্ন এর লেখায় কল্পনার পাশাপাশি সমসাময়িক ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ফরাসি ভাষায় লিখিত বইগুলি অধিকাংশ অনুদিত হয়েছে ইংরেজী ভাষায়। আগাথা ক্রিস্টির পর পৃথিবীতে যাঁদের বই সবচেয়ে বেশি অনুদিত হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম জুল ভার্ন।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

সেলিনা আক্তার শাপলা আমি একজন লেখিকা ও ব্লগার। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। এবং ম্যানেজার, দি ব্যাকস্পেস জার্নালে। লেখালেখির যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে সরাসরি ই-মেইল করুন: shelinaaktershapla123@gmail.com