অস্বীকৃতি: এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে এর কোনো মিল নেই। যদি দৈবক্রমে এই উপন্যাসের কোন চরিত্র বা বিশেষ কোন ঘটনা কারো জীবনের সাথে মিলে যায় তাহলে এই উপন্যাসটি সেজন্য কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না। এছাড়া কারো ধর্ম এবং রাজনৈতিক অনুভূতি কে আঘাত করার জন্য এই উপন্যাসটি লেখা হয় নি।
পরের দিন সকালে স্নেহা কে প্রস্তাব দিলাম একসাথে গ্রাম ঘুরে দেখবো বলে। স্নেহা কে ডাক দিতেই মনে হলো পূর্বে থেকেই রাজী ছিলো। তাই জিগ্যেস করার আগেই ‘হ্যাঁ’ বললো। অবশ্য মা একটু আপত্তি করলো, বললো, “এই গ্রাম আর আগের মত নেই, হাসান। সাবধানে যাও।”
এরপর দু’জন গ্রাম ঘুরে দেখবো বলে বের হলাম। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করা যায় সেটা আমি বুঝতে পারছি না। প্রাইমারী স্কুল থেকে দীঘি পর্যন্ত; অবশ্য মাঝ রাস্তায় চেয়ারম্যানের বাড়ি পড়বে। যদি এই নকশা ধরে দুজনে হাঁটি তাহলে মোটামুটি বিকেল গড়িয়ে যাবে। সন্ধ্যার মধ্যে বাড়িতে ফেরা সম্ভব।
শাড়িতে স্নেহা নিজেকে যেভাবে সাজিয়েছে, ও কে দেখে মুগ্ধ হতে হয়। তারপর সামনে এক কদম ফেলতেই আমার ডান হাতটা ধরে জানান দিলো, “আমরা একসাথে যাচ্ছি।” ওর মুখে হালকা লাল আভা খেলে গেল। এই প্রথম মনে হচ্ছে, আমি আমার এক জীবনে খুব ভালো একজন বন্ধু এবং প্রেমিকা পেয়ে গেছি।
পুরনো প্রাইমারী স্কুলে প্রবেশ করতেই বাচ্চাদের দোলনা দেখে স্নেহা কে আটকানো যাচ্ছিলো না। এক পর্যায়ে দু’জন মিলে ঝুল খেতে লাগলাম। ওর চুলগুলো আমাকে কি মিষ্টি বিরুক্ত করছে! বাচ্চাদের মত এসব কান্ড করতে আমারও ভালো লাগছে।
এরপর স্কুলের পুরনো কক্ষগুলো নির্দেশ করে আমাকে বললো,
- তোমার অতীত স্মৃতি সম্পর্কে আমাকে জানাবে না?
- যেমন…
- তোমার ছোটবেলার কোনো খেলার সাথী ছিলো না?
- ছিলো… ডজন খানেক তো হবে…
- না মানে স্পেশ্যাল কেউ! এখনো মনে পড়ে টাইপ…
- তুমি কষ্ট পাবে। ছাড়ো…
- না, একদম ছাড়ছি না। বলো?... আরেহ্ বলো… বলো?
- স্নেহা কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের জীবনে হাজারো স্মৃতি আছে। কিছু স্মৃতি একান্ত নিজস্ব। ওসব ভাগাভাগি করা যায় না বোধ করি। কিন্তু তোমার জেদ বলে কথা। নতুবা এই কৌতুহল শেষ হবে না।
- আমাকে যখন এত করে চেনো তখন চুপ কেন? শুরু করে দাও, হাসান…
তারপর আমি আমার সে বিশেষ একজন কে নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। কথা শুরু করতেই যেন অসংখ্য স্মৃতির সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত একের পর এক স্মৃতি মাথায় এসে আছড়ে পড়ছে।
ওর নাম ‘সূবর্ণা’। শুরু থেকেই আমাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব। এই স্কুল, এখানকার লাইব্রেরি, এই গ্রাম… এই সমস্তই আমাদের খুব চেনা ছিলো। একসাথে সকালে ক্লাস করতে আসতাম আবার একসাথে টিফিন ব্রেকে খাওয়া-দাওয়া করতাম। তারপর একসাথে দুজনে বাড়িতে ফিরে আসতাম।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, বিশেষ কেন? কারণ তখন আমার জীবনে ওর থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমার অসামাজিক এবং একরোখা ব্যক্তিত্ব কে প্রাণবন্ত রুপ দিয়েছিলো। কাকে কীভাবে সম্বোধন করতে হবে? অথবা, করা উচিত! এসব ওর কাছ থেকেই শেখা।
এভাবেই আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা কিন্তু যখন নবম শ্রেণীতে তখন আমার মধ্যে আচানক একটা ভয় কাজ করতে লাগলো। সূবর্না কে হারানোর ভয়। কারো ওপর এতটা নির্ভরশীল হওয়ায় তার প্রস্থানের ভয়।
আমার কন্ঠ তখন আস্তে আস্তে ভারি হচ্ছিলো। আর ওর স্পর্শ কেমন জানি অদ্ভুত ভালোলাগার হয়ে উঠতে লাগলো। একদিন ক্লাস শেষে দুজনে দীঘির পাড়ে বসে গল্প করছিলাম। কখন জানি বিকেল শেষে সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমরা টের পাইনি।
ও সুযোগ পেলেই আমার কাঁধে মাথা রাখতো। সেদিন সন্ধ্যায় কি যেন হলো… আমি ও কে বুকে জড়িয়ে নিলাম। বুঝলাম এতে ওর কোনো আপত্তি নেই। ওর শরীরটা আমাকে এমন ভাবে দিয়েছে যেন, সে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। একসময় ওর উষ্ণ ঠোঁটে আমার ঠোঁট রাখলাম।
সেদিনের এই ঘটনার পর বুঝলাম আমাদের মধ্যে কিছু একটা আছে। এরপর প্রায় প্রায় আমরা একান্তে সময় কাটাতাম। ভালো লাগতো। কিন্তু কখন জানি আমরা স্কুলের বারান্দা শেষ করে কলেজে পা দিয়েছি। স্কুলের মত করে তখনো সূবর্ণা আমার সাথে আমার সাইকেলে চড়ে যেত। এখান থেকে বেশ দূরে হলেও গল্পে গল্পে সময় কেটে যেত।
আমাদের ওমন খোলামেলা মেলামেশা কেউ আর ভালোভাবে নিতে পারছিলো না। গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে আমার মত সাধারণ কেউ থাকাটা সাধারণদের জন্যেও অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তখনও আমরা বড় হইনি।
একদিন চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে আমার মা কে তলব করা হয়। শিহাব তখনো অনেক ছোট। মা বাড়িতে এসে তেমন কিছুই বলছিলো না। আমি আমার রুমে বসে আছি ঠিক কি হলো সেটা জানার জন্য। একটুবাদে পেছনে ফিরে তাকাতেই আমার ছোট ভাই শিহাব কে দেখতে পেলাম।
ওর চোখে জল। আমি একটু অবাক হলাম। শিহাব কে তো আমরা কেউ শাসন করি না। তাহলে কি হয়েছে ওর?
- শিহাব… কি হয়েছে ভাই?
শিহাব তখনো খুব ভালো করে কথা বলতে শিখেনি। আমতা আমতা করে বললো, “ভাইয়া, তুমি সূবর্ণা আপুর সাথে আর… দেখা কোরো না… ওরা তোমাকে মেরে… ফেলবে…”
- শিহাব, এসব কে বলেছে তোকে?
- চেয়ারম্যান
এরপর উঠে দাঁড়ালাম। হাতে এক আম কাটার এক চাকু ছিলো। ওটা নিয়ে সরাসরি চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলাম। সূবর্ণা আমাকে এমন বিভৎস অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একবিন্দুও দেরি না করে সরাসরি চেয়ারম্যানের ঘরে গিয়ে চাকুটা ওনার গলায় ধরে বললাম, “তোর মরার খুব শখ জাগছে, তাই না! বাবা নাই তাই বলে আমাদের কমজোড় ভাবোস! দেই? একেবারে খেলা খতম করে দেই?”
স্নেহা ‘হা’ করে সব শুনছে। একসময় আমি থেমে যাওয়ায় ওর আগ্রহ আরো বেড়ে উঠলো। ‘হ্যাঁ, হাসান, তারপর কি হলো?’
- তারপর সূবর্ণা এসে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে। আর এটাও বলে যে, “সে আমার সাথে আর দেখা করবে না।”
- কেন?
- কারণ ওর মনের মধ্যে আমাকে নিয়ে এবং আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভয় জন্মেছিলো। যে গ্রামে মেয়েদের ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে দেওয়া হয় সেখানে সূবর্ণা আঠারো বছর বয়সেও পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে সেটাই কি বেশি নয়!
- তাই বলে তোমায় ছেড়ে দেবে? আমি থাকলে ওমন করতাম না…
- না, ছেড়ে দেয় নাই। তোমরা শহুরে মানুষ গ্রামকে যেভাবে দেখো, গ্রামের হিসেবটা ওরকম নয়। ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণা নেই।
- তাহলে সূবর্ণা কই?
- আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো… কিন্তু আমি সেটা ঘটতে দেয়নি… ওর বাবা এক বিদেশ ফেরত ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়।
- তারপর?
- তারপর কিছু নেই… ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজানো এই ফিতা এখানেই শেষ…
স্নেহা একটু হোঁচট খেলো জানি… দোলনাটা আস্তে করে কখন জানি থেমে গেছে। স্নেহার দিকে তাকাতেই বলে উঠলো, “আচ্ছা, মাত্র আঠারো বছর বয়সে তোমার এত সাহস ছিলো?”
আমি শুধু বললাম সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটি পড়েছো কখনো?
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয় -
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
…………………………
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয় -
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
(ছবি সংক্ষেপ: মহারাণী ভবানীর স্মৃতি বিজড়িত নাটোর। ৪৯.১৯২৫ একর জমির ওপর নাটোর রাজবাড়ী নির্মিত হয়েছিল। রাজা রামজীবন নাটোর রাজবাড়ীর প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬ মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং সে বছরেই মৃত্যুবরণ করেন। রাজা রামজীবনের মৃত্যুর পর রামকান্ত ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের রাজা হন। অনেকের মতে ১৭৩০ থেকে ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা রামজীবনের দেওয়ান দয়ারাম নাটোরের তত্ত্বাবধান করতেন। রাজা রামকান্ত তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোরের রাজত্ব করেন।)
দত্ত পরিবার’ উপন্যাসের ৯ম পর্ব পড়ুনঃ উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব - ০৯)