শেষের কবিতা: বিশ্ব সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অনুপম কৃতি
‘শেষের কবিতা’ এর প্রথমে নাম ছিলো, ‘মিতা’। উপন্যাসের সময় কাল ১৯২৯ সাল। ‘শেষের কবিতা’ এর একটি সূচনা পর্ব আছে - ১৯২৮ সালে দাক্ষিনাত্যে ভ্রমন সঙ্গী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ ও নির্মল কুমারী মহলানবীশের অনুরোধক্রমে রবি ঠাকুর মুখে মুখে শেষের কবিতার সূচনা পর্ব শুনিয়েছিলেন।

অমিত, আমার জন্ম লগ্নে আছে চাঁদ, ঐ গ্রহটি কৃষ্ণা চতুর্দশীর সর্বনাশা রাতেও একটুখানি মুচকি না হেসে মরতেও জানে না…
আজ সকালে হঠাৎ খেয়াল হলো আমার জানা সাহিত্যের ভিতর হতে এমন একটা লাইন বের করি যেটা মনে হবে স্বয়ং আমি এই মাত্র লিখলুম, আর কোন কবির লেখবার সাধ্যই ছিল না। লাবন্য থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো, বের করতে পেরেছেন? হ্যা, পেরেছি। লাবন্যর কৌতুহল বাধা মানলো না, বলে ফেললো - লাইন ক’টা কি বলুন না! অমিত খুব আস্তে কানে কানে বলার মতো বললো -
“For God's sake, hold your tongue
লাবন্যর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। অমিত বললো- আপনি নিশ্চয় জানেন লাইনটা কার? লাবন্য মাথা বেঁকিয়ে ইশারায় জানিয়ে দিল- হ্যাঁ। অমিত- সেদিন আপনার টেবিলে ইংরেজ কবি ডন এর বই আবিষ্কার করলাম, নইলে এ লাইন আমার মাথাতে আসতো না।
আবিষ্কার করলেন?
মনে হলো অন্যকবির দরজায় ঠেসা ঠেসি ভীড়, ডন এর কাব্যমহল নির্জন। ওখানে দুটি মানুষের পাশাপাশি বসবার জায়গাটুকু আছে। তাই আমি স্পস্ট করে শুনতে পেলুম আমার সকাল বেলার মনের কথাটি,
দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর
‘শেষের কবিতা’ এর প্রথমে নাম ছিলো, ‘মিতা’। উপন্যাসের সময় কাল ১৯২৯ সাল। ‘শেষের কবিতা’ এর একটি সূচনা পর্ব আছে - ১৯২৮ সালে দাক্ষিনাত্যে ভ্রমন সঙ্গী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ ও নির্মল কুমারী মহলানবীশের অনুরোধক্রমে রবি ঠাকুর মুখে মুখে শেষের কবিতার সূচনা পর্ব শুনিয়েছিলেন।
গল্পটি খুবই সংক্ষেপে বলছি, কারণ সেটি এতো ছোটো ও এতো শুকনো মোটেও নয়। একটি ছেলে ও মেয়ে রোজই ফোনে কথা বলে। কেউ কারো নাম জানে না, পরিচয় তো নয়-ই। রোজ তারা এক দুজনের ফোনের অপেক্ষা করে। ছেলেটি মেয়েটিকে শুধু এইটুকু বলেছে, সে আসতে চায়, পরিচয় করতে চায়, কিন্তু সে আসবে না, তার মনে ভয় যদি দেখা হলো এই ভাল লাগা টুকু চলে যায়! তাই সে দুরেই থাকতে চায়…
কিছুদিন পরে শিলং পাহাড়ে মেয়েটি চেঞ্জে গেলো। সেখানে গাড়ী অ্যাক্সিডেন্টে যে ছেলেটি তাকে সাহায্য করলো, তার গলার আওয়াজে মেয়েটি চমকে উঠলো। বুঝলো এই সেই টেলিফোনের গলা। ফোনেই তাদের এতো ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিলো এতটুকু কষ্ট হলো না পরস্পর কে চিনতে। ২৫ শে জুন ব্যাঙ্গালোরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কেও এই বিবরণ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘শেষের কবিতা’ এর মোটমোটি চরিত্র সংখ্যা আটটি। নায়ক অমিত রায়, নায়িকা লাবন্য দত্ত। এ ছাড়া শমিতা (সিসি), লতিকা (লিসি), কেতকী মিত্র (কেটি মিটার), শোভন লাল, যতিশংকর, যোগমায়া।
অমিত রায় উচ্চশিক্ষিত, বৈভব শালী, অক্সফোর্ডে পড়া, এক নবীন যুবক, ইঙ্গবঙ্গ সমাজের প্রতিনিধি, রোমান্টিক কথা বলতে ওস্তাদ, মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে, রবি ঠাকুর কে নিয়ে যা-তা বলে, আর নিজে নিবারণ চক্রবর্তী ছদ্ম নামে কবিতা লেখে। এভাবে একটি কবিতা পরবর্তী কালে বিখ্যাত হয়ে গেছে,
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
ব্যারিষ্টার অমিত রায় ইংরেজি ছাঁদে ‘রয়’ রুপান্তরিত হয়ে ‘রে’ হলো। নামের শ্রী ঘুচে নাম উচ্চারিত হলো, ‘অমিত রায়ে’। এ প্রসঙ্গে অমিত বলে - ফ্যাশনটা মুখোশ, স্টাইলটা মুখশ্রী। ওর চেহারায় একটা বিশেষ ছাঁদ আছে, পাঁশ জনের মধ্যে ও যে কোনো একজন নয়।
এ দিকে ওর দুই বোন সিসি, লিসি যেন নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি, ফ্যাশন পসরায় আপাদ মস্তক মোড়া পয়লা নতুন প্যাকেট বিশেষ। ‘শেষের কবিতা’র নায়িকা লাবন্য দত্ত - রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সশক্ত ভাবে এই চরিত্র গড়েছেন।
লাবন্যর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, প্রভুত্ব, যে নিজের শর্তে বাঁচতে চায় এমন এক নারী চরিত্র। এই স্ত্রী চরিত্র কিছুতেই ভুলতে পারা যায় না। সে সকলের মনে দাগ কেটে দেয়। উপন্যাসের অন্য চরিত্রদের ধীরে ধীরে দেখা যাবে, এখন এগুনো যাক নায়ক, নায়িকা কে নিয়ে।
অমিত ক’দিন কাজ থেকে একটু রিল্যাক্স হতে বেছে বেছে শিলং-য়ে গেলো। এই জন্য আরো ওখানে কন্যা গণেট মাতাগন পা দেবেন না তাঁরা দার্জিলিং প্রেমিকা। তার বোনেরাও সব সেই স্থানে। অমিতের এক কালের প্রেমিকা বিমি বোস যখম দেখলো ভাই ছাড়া বোনেদের আগমন ঘটলো তখন সে চারিদিকে চেয়ে আবিস্কার করলো দার্জিলিং নির্জনতা আছে, মানুষ নেই।
অমিত শিলং আরো এই জন্য গিয়েছিলো নির্জনতা ভোগ করবে, কিন্তু বুঝলো জনতা না থাকলে নির্জনতার স্বাদ মরে যায়। ক্যমেরা হাতে দৃশ্য দেখা তার চরিত্রের অঙ্গ নয়- সে বলে আমি ট্যুরিস্ট নই, আমি মন দিয়ে চাখি খাবার, চোখ দিয়ে গিলি না।
এই শিলংয়ে তার গাড়ীর সঙ্গে আর একটি গাড়ীর অ্যাক্সিডেন্ট ঘটলো। পাহাড়ী পথে অমিত ওপর থেকে দেখলো একটি গাড়ী ওপরে উঠে আসছে। পাশ কাটানোর জায়গা নেই ব্রেক কষতে গিয়ে পরলো তার ওপরে - পরস্পর আঘাত লাগলো কিন্তু অপঘাত ঘটলো না। অন্য গাড়ীটা গড়িয়ে পাথরে আটকে গেলো।
একটি মেয়ে গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়ালো। মনে হলো মহাসাগরের বুক ফুলে ফেঁপে ঢেউয়ের উপরে রাজেন্দ্রানী লক্ষী দাঁড়ালেন। অমিত পরিপুর্ন দৃস্টি মেলে চেয়ে দেখলো। মনে হলো পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায় কিন্ত তাকে দেখবার জায়গা পাওয়া যায় না। এ মেয়ে কে ড্রয়িং রুমে পরিপূর্ন দেখা যেত না।
অমিত তার সামনে চুপ করে গিয়ে দাঁড়ালো বললো- অপরাধ করেছি। মেয়েটি হেসে বললো- অপরাধ নয়, ভুল। পরে অমিত ভেবে দেখেছে ঐ মেয়ের কণ্ঠস্বর যেন অম্বুরি তামাকের ধোঁয়া, নিকোটিনের ঝাঁঝ নেই। আছে গোলাপ জলের স্নিগ্ধ গন্ধ।
কখন প্রেমের শুরু? কখন মদনদেব তাঁর বান চালিয়ে দিলেন তা কেউ বুঝলো না। এ যেন এক বেড়া চুরমার হয়ে ভেঙে গেলো। এ কোন দৈব দুজনের মনের গাঁঠ বেঁধে দিলেন মন দেখা দেখির। যোগমায়া দেবীর মেয়ের গভর্নেসের চাকরিতে নিযুক্ত লাবন্য, পড়াবার নাম আছে তার। লাবন্য অমিতের সঙ্গে যোগমায়া দেবীর আলাপ করাতে ভিতরে নিয়ে এলো। যোগমায়া দেবী অমিত দেখেই স্থির করলেন তার সঙ্গে লাবন্যর বিবাহ দিতেই হবে।
অমিত বলে লাবন্যকে, আপনি আমার নাম জানেন তো!
- ওটা আপনার মুখে মানায় না।
- ও আপনি ইংরেজি কায়দা পছন্দ করেন মি. রয়?
অমিত বলে, অমিত বাবুর বাবুটা বাদ দিন না! লাবন্য বলে, সময় লাগবে। অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে তারা যেন পূর্নিমা রাতের তারা আর লাবন্য যেন ভোর বেলার অপরাজিতা এই টিই অমিত কে দারুণ নাড়া দিলো।
এক সন্ধ্যায় এক জলধারার পাশে ইউক্যালিপটাসের গাছের তলায় অমিত লাবন্যকে বলে,
হে অচেনা,
আবৃত্তি শেষ করে অমিত লাবন্যর হাত চেপে ধরলো, লাবন্য হাত ছাড়িয়ে নিল না। চুপ করে অমিতের দিকে চেযে রইলো। আর কোনো কথার দরকার হলো না। লাবন্য ঘড়ির দিকে চাইতেও ভুলে গেলো। এমনি আর এক সন্ধ্যায় তারা দুজনে দুজনকে একটি করে নাম দিলো। অমিত দিলো বন্যা এবং লাবন্য নাম দিলো মিতা।
অমিত, লাবন্যর প্রেমের গতিমানতা চলতে থাকে। অমিত কিন্তু চায় তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে লাবন্য কে সম্পূর্ণ পাওয়া। অথচ লাবন্য বুঝেছে তাদের সমাজ কত ভিন্ন! বিবাহ হলে অমিতের কবি মনের কল্পনা মন একেবারে ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে।
এক অসাধারণ প্রেম এক অতি সাধারণ জীবনে পরিণত হবে। লাবন্য অমিত কে বোঝায় মেয়েদের প্রতি তার আকৃষ্ট হওয়া। তার সব কল্পনাশীলতা ফুৎকারে উড়ে যাবে। লাবন্য অমিত কে বোঝায়, কলকাতায় বিয়ের পর ঘর সংসার করতে গিয়ে অমিত টের পাবে যে লাবন্য ওর কবি মনের কল্পনায় তৈরি।
লাবন্য অমিত কে তার মুখের ওপর তার চরিত্র স্পষ্ট করে দেয়, তাকে বিবাহের প্রত্যাখ্যান করে প্রেমের পর বিবাহ প্রত্যাখান করা পুরুষের একচেটিয়া অধিকার লাবন্য দেখায়। অবশ্য অমিতও ভেতরে ভেতরে এই সমাজের অন্তঃসার শুন্যতা অনুভব করে। এর আগে তাদের এনগেজমেন্টের হবার খবরে সিসি, লিসি, কেটি এসে ইতিহাসের অধ্যাপকের গভরনেস মেয়ে লাবন্যকে পরিহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে।
কেটি মিটার আসলে কেতকী মিত্র। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় আজ থেকে সাত বছর আগে তার পুর্ব-প্রেমিকা কেটি কে আংটি পরিয়েছিলো। সেই আংটি আজ চোখের জলে ফিরিয়ে দিলো কেতকী। কলকাতায় ফিরে অমিত কেটী নয় কেতকীকে বিয়ে করলো।
অবশ্য লাবন্যই বুঝিয়েছিলো অমিত কে যে ঐ রংমাখা কেটী অমিতেরই অবহেলার ফল। লাবন্য বিয়ে করে শোভন লাল কে। তার বাবার সেই মুখচোরা ছাত্র, যাকে একদিন সে অপমান করে বিতাড়িত করেছিল।
লাবন্যর ভাই যতিশংকর কে অমিত বলেছিলে, কেতকী ও লাবন্য দুজনেই তার ভালোবাসা। তবে কেতকী যেন ঘড়া ভরা জল, প্রতিদিন জল তোলা, প্রতিদিন ব্যবহার করা আর লাবন্য ঘরের পাশে দিঘী তাতে তার সাঁতার কাটা।
যতিশংকরের হাতে লাবন্য পাঠায় তার ও শোভন লালের বিয়ের চিঠি। তার অপর দিকে লিখে দেয় এক অসামান্য কবিতা, শেষের কবিতা। অনেকের মতে ‘শেষের কবিতা’ বিষয়বস্তু হলো শ্রেয় (যা কল্যাণ কর) ও প্রেয় (যা মন কে ভোলায়) তার এক দ্বন্দ্ব। অনেকের মতে, কোন একজন কে দিয়ে সবার চাহিদা পুরণ হয় না। মনের মধ্যে এক অব্যক্ত, বিমূর্ত আকুতি মাঝে মাঝে জেগে ওঠে।
সোভিয়েত রাশিয়াতে শেষের কবিতা নিয়ে ফিল্ম নির্মাণ হয়েছিল - যার ইংরেজি নামকরণ ‘Could One Imagine’।
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?






