প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার (Competitive Advantage) সারাংশ এবং সফলতার উদ্দেশ্যে যাত্রা

এই অতিদ্রুত গতিসম্পন্ন ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার জগতে ‘প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা’ লাভ করা দীর্ঘমেয়াদী সফলতার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে। ‘প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা’ বিষয়টি কৌশলগত ব্যবস্তাপনার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজ আমরা এই ব্লগের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার নিগুঢ়তা উন্মোচন করবো, তার প্রত্যেকটি উপাদান সম্পর্কে পরিচিত হবো এবং কৌশলগত উন্নতি লাভে কেন্দ্রীয় কি কি ভূমিকা সে রাখে তার সম্পর্কে জানবো।

জুল 5, 2023 - 20:00
জুল 5, 2023 - 13:53
 0
প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার (Competitive Advantage) সারাংশ এবং সফলতার উদ্দেশ্যে যাত্রা
প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার (Competitive Advantage) সারাংশ এবং সফলতার উদ্দেশ্যে যাত্রা | Image by rawpixel.com on Freepik

প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার মূলতত্ত্ব সমুহ

প্রকৃত অর্থে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার তাৎপর্য বুঝতে গেলে, এর গোঁড়া কে বুঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে চলুন কৌতুহল নিয়ে পরবর্তী বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা যাক,


. প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা আসলে কি?

সংগঠনর সেসকল গুণাগুণ, ব্যবহারযোগ্য সম্পদ এবং সামর্থ্য যা তাকে তার প্রতিযোগী সংগঠন গুলো থেকে আলাদা করে। এটা যে কোনো সংগঠনকে তার প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে যেতে এবং ব্যবসাতে সর্বোচ্চ ফলাফল লাভে সহায়তা করে।


নিজের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা খুঁজতে যেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদা নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন
করতে থাকে ও বাজারের অন্যান্য প্রতিযোগীদের থেকে নিজেদের আলাদা করে পরিচয় করে দেয়।



. প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার প্রকারভেদ

টার অনেকগুলো প্রকারভেদ আছে। যেমন ধরুন - দামের দিক দিয়ে আধিপত্য (Cost Leadership), ভিন্নধর্মীতা (Differentiation), কেন্দ্রীভূত কৌশল (Focus Strategy)


দামের দিক দিয়ে আধিপত্য (
Cost Leadership) যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে তার ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারনের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে তার গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়, তার অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনা


ভিন্নধর্মীতা (
Differentiation) মনোনিবেশ করে অনন্য এবং বহুল চাহিদা যুক্ত পণ্য/সেবা প্রস্তুত করতে যা বাজারে সবার চাইতে ভিন্ন হয়।


কেন্দ্রীভূত কৌশল (
Focus Strategy) এ যেকোনো বাজারের ক্রেতাদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে বিবেচনায় রেখে তাদের বিশেষ প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য/সেবা কে প্রস্তুত করা হয়।



. টেকসই/দীর্ঘমেয়াদী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা (Sustainable Competitive Advantage)

টেকসই/দীর্ঘমেয়াদী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা (Sustainable Competitive Advantage) বলতে একটি সংগঠনের তার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দীর্ঘ সময় ধরে টিকিয়ে রাখার সক্ষমতাকে বুঝানো হয়। এই দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার অন্তরালে কোন প্রতিষ্ঠানের এমন কিছু বিশেষ বিশিষ্ট্য কাজ করে যা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য নকল করা/অনুকরণ করা কঠিন, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভব।


দুষ্প্রাপ্য সম্পদ
, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও যেকোনো শিল্পে আত্মপ্রকাশ করার আগে কৌশলগত বাধা (Strategic Barriers To Entry) ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার দীর্ঘস্থায়ীত্বের পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরুপ: কোকা-কোলা তাদের টেকসই/দীর্ঘমেয়াদী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ধরে রেখেছে উপকরণের তালিকার গোপনীয়তা রক্ষা ও বিশ্ব জুড়ে তাদের সংগঠনের পরিচিতির উপর ভিত্তি করে। এবং এইগুলো কোকা-কোলাকে পানীয় জগতে তাদেরকে যুগের পর যুগ টিকিয়ে রেখেছে।



কৌশলগত নেত্রীত্বের উপর প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার প্রভাব

যেকোন সংগঠনের উন্নতি করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবার আমরা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানবো।


. বাজারের উপর কর্তৃত্ব স্তাপন (Gaining Market Dominance)

প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা সংগঠনদের তাদের নিজ নিজ শিল্পের বাজারের প্রয়োজনীয় অংশ নিজেদের হস্তগত করতে ও বাজারে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে প্রয়োজনীয় ভুমিকা পালন করে। উদাহরনস্বরুপ গুগল এর কথাই ধরা যাক, যে সার্চ ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রি-তে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে তার সর্বোত্তম প্রযুক্তি ও ব্যবহারকারীর অনুভবের (User experience/UX) উপর ভিত্তি করে। গুগল এর সমাধান পদ্ধতি (Algorithm) ও বিস্তারিত ফলাফল প্রদর্শন মানুষের মন জয় করে নেয় যা তাদের বাজারে প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে।



. ভিন্নধর্মীতা ও মান সৃষ্টি (Value Creation)

প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা যেকোনো সংগঠনকে তার ক্রেতা সাধারণের কাছে অনন্য মান (Unique Value) বিতরণের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে দেয়, যা তাদেরকে তাদের প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করে। ভিন্নধর্মী বিশিষ্ট্য, মৌলিক গুণগতমান অথবা ক্রেতা সেবা প্রদান করার মাধ্যমে সংগঠন তার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি করে যা তাকে ক্রেতাদের বিস্বাস্ততা অর্জন করে দেয়।


যেমন, 
নাইকি/নিক (Nike) যারা পৃথিবীর স্বনামধন্য ক্রীড়াবিদদের জন্য জুতা তৈরি করে, তারা উ‌দ্ভাবন ও উচ্চমানের নকশাতে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা ক্রেতাদের মনে সর্বোচ্চ মান ও সুরুচিপূর্ণ নকশার অনন্য নাম হইয়া গেছে।



. দীর্ঘমেয়াদী লাভ (Sustainable Profitability)

যেকোন সংগঠনের দ্রব্য/সেবার অন্যান্য প্রতিযোগীদের দ্রব্য/সেবার তুনলায় সব্বোচ্চ দাম নির্ধারণ/দাম কমানো অথবা উভয়ই করা সম্ভব হয় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার সাহায্যে। ভিন্নধর্মী কৌশল (Differentiation Strategy) যেকোন সংগঠনকে সাহায্য করে তার ভিন্নধর্মী পণ্য এর জন্য সরবচ্চ দাম নির্ধারণ এর জন্য যা তাদের লভ্যাংশ বাড়িয়ে দেয়।


অপরদিকে দামের দিক দিয়ে আধিপত্য কৌশল (
Cost Leadership) যেকোন সংগঠনকে তার দ্রব্য/সেবা সর্বনিম্ন মূল্যে দিতে সাহাযয করে যা তাদের কাজের গতি ও লাভ বাড়িয়ে দেয়। সাউথওয়েস্ট এআরলআইনস (Southwest Airlines) এর মত প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদী লাভ এভাবেই করতে পেরেছে।


প্রয়োগসংক্রান্ত সক্ষমতা (
Operational Efficiency) বাড়িয়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যতে বিমান টিকেট দেয়ার মাধ্যমে এরকম চরম প্রতিযোগিতাসম্পন্ন শিল্পে তারা অত্যন্ত অর্থনৈতিক সাফল্য পাচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে।



প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরির কিছু কৌশল


. পরিবেশগত বিশ্লেষণ

বাহ্যিক পরিবেশ সম্পর্কে গভীর পর্যালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে সুযোগ-সুবিধা ও হুমকি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে যা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা সৃষ্টি করতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। কিছু কিছু পদ্ধতি যেমন পেসটেল এনালিসিস (PESTEL = Examining Political, Economic, Social, Technological, Environmental & Legal Factors) যা যেকোন জায়গার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রজুক্তিগত ও আইনগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করে এবং Porter’s Five Forces যা শিল্পের বর্তমান প্রতিযোগিতা, ক্রেতা ও যোগানদাতাদের দর কষাকষির ক্ষমতা ইত্যাদি আলোচনা করে ও সংগঠনকে তার বাজার সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে সাহায্য করে।



. নিজ সম্পদ ও ক্ষমতার মূল্যায়ন

যেকোন প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা সৃষ্টি করতে গেলে অবশ্যই দরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা। VIRO Analysis (Value, Rarity, Inimitability, and Organization of Resources) যা মান, দুষ্প্রাপ্যতা, অনুকরণীয়তা ও সম্পদের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে বিবেচনা করে ও Core Competency Model, সাহায্য করে উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি করতে।



. উদ্ভাবন ও ধারাবাহিক উন্নতি

প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা সৃষ্টি ও সময়ের সাথে সাথে তাকে বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবন ও সংগঠনএর মধ্যে সময়ের সাথে সাথে উন্নতি করার মানসিকতার প্রচলন খুবই প্রয়োজনীয়। সংগঠনকে সবসময় এগিয়ে থাকতে গেলে সক্রিয়ভাবে উন্নতির সন্ধান, বাজারের বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা ও পণ্যের গবেষণার জন্য বিনিয়োগ করা দরকার।



পরিশেষ

সবশেষে আমরা জানতে পারলাম যে, কৌশলগত ব্যবস্তাপনায় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কতোটুকু ভুমিকা রাখে। এটা সাফল্যের দিক নির্দেশনা দেয়, সংগঠনকে তার নির্দিষ্ট বাজারে আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করে, অন্য প্রতিযোগীদের থেকে নিজেকে আলাদা করে পরিচয় করে নিতে সাহায্য করে এবং সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদী লাভ অর্জন করতে সাহায্য করে।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow