কবিতার প্রাথমিক নাম ছিলো ডিকেন্সের উপন্যাস ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ থেকে নেওয়া ‘হি ডু দ্য পুলিস ইন ডিফারেন্ট ভয়েসেস’। সেই ৪৩৪ লাইনের কবিতায় কাটছাঁট করে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’।
যিনি লিখলেন - টি এস এলিয়ট
যিনি কাটছাঁট করলেন - এজরা পাউন্ড
দুই দিকপাল কবি, দুই নিকট বন্ধু। আত্মপ্রকাশ করেছিলো ইংল্যান্ডে ১৯২২ - অক্টোবর। পর পর ‘দ্য ক্রায়েটারিয়ান’ ও ‘দ্য ডায়াল’ পত্রিকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংস ও নিরাশার প্রেক্ষাপটে ভাঙনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই আধুনিক কবিতার দিক চিহ্ন কবিতা যার ‘জননী’ টি. এস. এলিয়ট ও ধাত্রী মা এজরা পাউন্ড।
কৌতুকের সুরে বলেছিলেন এই সম্পর্কের কথা এজরা পাউন্ড তাঁর ‘সেজ হোম’ কবিতায় এজরা কেই উৎসর্গ করা এলিয়ট এর এই ভাঙনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আধুনিক কবিতার দিক চিহ্ন ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ - পার করা ‘একশো বছর’ - খেয়াল নাই সাহিত্য প্রেমীদের!
জেসি ওয়েস্টন এর ‘ফ্রম রিচুয়াল টু রোমান্স’ ও জেমস ফ্রেজার এর ‘দ্য গোল্ডেন বাউ’ দুই গ্রন্থে বর্ণিত গ্রেল উপকথা আর প্রাচীন নৃতত্বের কাহিনী কে সুতো দিয়ে বেঁধে বেঁধে নির্মাণ করেছেন রুপক কাঠামো, তার গড়ন, মুক্তছন্দ দৈনন্দিন বাকরীতি, এক গীতি কবিতার মিশেল, বহু কণ্ঠস্বরের মিলন সমাবেশ, সব মিলে মিশে এক আধুনিক যুগ যন্ত্রণার অভুতপুর্ব দলিল, এক কাঠামো টি. এস. এলিয়ট এর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’।
ওভিদ, উইলিয়াম শেকসপিয়র, ওয়েবস্টার, মিডলটন, বোদলেয়ার উদ্ধৃতি আপাতদৃষ্টিতে কবিতাকে দুরুহ, আর বাইবেল, উপনিষদ ও বৌদ্ধ দর্শনের অনুসঙ্গ এর উত্তরণ ঘটিয়েছে। এই কবিতায় সংযোগ ঘটেছে কবির স্বকৃত টীকা সে ভিন্ন কবিতা পাঠ অপূর্ণ থাকে, এটি আধুনিকতার এক নতুন দিক।
কবি তথা সুচিন্তক এলিয়ট এর মতে আধুনিক মানুষের মন জটিল আবর্তে চলে, তাই এ যুগের সাহিত্য সহজ, সরল রুপ নিতে পারে না – ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এই ভাবনার প্রতিফলন। এই কবিতা পাঁচটি অংশে বিভক্ত,
১. দ্য বেরিয়াল অব দ্য ডেড
২. দ্য গেম অব চেজ
৩. দ্য ফায়ার সারমন
৪. ডেথ বাই ওয়াটার
৫. হোয়াট দ্য থান্ডার সেড
এই পাঁচটি অংশ আলাদা ভাবে পাঠে খাপছাড়া মনে হতে পারে কিন্তু একটু গভীরে মনোযোগে পড়লে এর যোগসূত্র খুঁজে নিতে অসুবিধে হয় না। দান্তের নরক দর্শণ, সন্ত অগাস্টাইনের প্রার্থনা, আর মেলামেশা ভগবান বুদ্ধের অগ্নি - উপদেশ।
খ্রীষ্টের দেহত্যাগ ও আর্তি ছড়িয়ে যায় বিশ্বে। জেরুজালেম আথেন্স আলেকজান্দ্রিয়ার ভেঙে পড়া থেকে বহু দূরে হিমালয়ের মেঘ বলে, ‘'দ’, ‘দ’, ‘দ’ - বৃহদারন্যক উপনিষদের প্রতীকী উচ্চারণ পশ্চিমি অবক্ষয়ের থেকে ইতিবাচক আদর্শ দিতে পারে প্রাচ্য দর্শণ - এই ইঙ্গিত 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড' এর শেষ পর্বে।
টি. এস. এলিয়ট এর এই কবিতা আধুনিক কবিতার পথ নির্দেশক হয়ে উঠিছিলো। নানা পন্ডিত বলেছিলেন, ঠিক কোন ধারাপথে এই কবিতাকে নির্দিষ্ট করা যায়! আই এ রিচার্ডস - এর মতে, এটি মিউজিক অব আইডুয়াজ। পরবর্তী সময়ে এলিয়ট বলেন, “জাস্ট এ পিস অব রিদমিক্যাল গ্রাম্বলিং” ।
১৯২১ সালে এলিয়ট ও তাঁর স্ত্রী মানসিক স্নায়ু রোগে অনিদ্রা রোগে ভুগে অসুখী দম্পতি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের এই ব্যক্তিগত দিক ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এক জায়গায় ফুটে ছিলো, পরে তা কবি বাদ দিয়েছিলেন। এক বালুকা বেলায় বসে লেখেন ‘নাথিং উইথ নাথিং’ – ‘নেতি’ কে ‘নেতি’ র সঙ্গে যোগ করেন।
বাংলায় এলিয়ট এর ভাব শিষ্য বলে পরিচিত কবি বিষ্ণু দে ওয়েস্ট ল্যান্ড এ প্রভাবিত হয়ে লেখেন, নাম রেখেছি কোমল গান্ধার এ সাম্রাজ্যের অন্তিমে কি লর্ড এলিয়ট ওয়েস্ট ল্যান্ডে হর্ষে যেন আপন স্বদেশ…
সুধীন্দ্রনাথের কবিতা ‘চোরাবালি’, ‘ফণিমনসা’ - তে আছে ওয়েস্ট ল্যান্ড এর অনুসঙ্গ। জীবনানন্দের দুরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙে’র মতো উচ্চারণ মনে করায় জেরুজালেম আলেকজান্দ্রিয়া আথেন্স এর মতো ‘অলীক শহর’ ধ্বংস হয়ে যাবার চিত্রকল্প।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়ের মুখে মুখে ফিরতো ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। আজ সে একশো বছর হয়ে উঠেছে।
ধন্যবাদান্তে
পৃথা কুন্ডু
আরো পড়ুনঃ আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো’র আবির্ভাবের শতবর্ষ!