সূরা আল-আলাকের তাফসির

আজকে আমরা আপনাদের জানাবো সূরা আল-আলাক এর তাফসীর সম্পর্কে। সূরা আল-আলাক এর নাযিলের সময়কাল। সূরা আল-আলাক এর বিষয়বস্তু। এ ব্যাপারে আর জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।

অগাস্ট 18, 2023 - 11:00
অগাস্ট 18, 2023 - 22:35
 0
সূরা আল-আলাকের তাফসির
সূরা আল-আলাকের তাফসির | ছবি: সংগৃহীত

নামঃ দ্বিতীয় আয়াতের আলাক শব্দ থেকেই এর নামকরণ করা হয়েছে। 

নাযিলের সময়ঃ নাযিলের সময়ের দিক দিয়ে এ সূরাটি দু'ভাগে বিভক্ত। পয়লা ৫ আয়াত হেরা গুহায় নাযিল হয়। এটাই রাসূল (সা.)-এর উপর সর্বপ্রথম ওহী। সূরার বাকী ১৪টি আয়াত আরও পরে ঐ সময় নাযিল হয়, যখন রাসূল (সা.) কাবা শরীফে নামায আদায় শুরু করেন এবং আবু জাহল তাঁকে ধমক দিয়ে নামাযে বাধা দেবার চেষ্টা করে


প্রথম ওহীঃ হযরত আয়েশা (রা.) থেকে জানা যায় যে, রাসূল (সা.)-এর উপর সত্য স্বপ্ন দ্বারা ওহী আসা শুরু হয়। স্বপ্ন দেখার সময় তাঁর মনে হতো যেন দিনের আলোতে তিনি স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছেন। এরপর তিনি নির্জনে থাকা পছন্দ করতে লাগলেন এবং হেরা গুহায় রাতের পর রাত ইবাদাতে কাটাতে থাকলেন একদিন হেরা গুহায় থাকা কালে হঠাৎ জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন, পড়ুন। হযরত আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.)-এর নিজের কথায় এর যে বিবরণ দেন, তা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে ফেরেশতার কথার জওয়াবে আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি নাতখন ফেরেশতা আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন চাপ দিলেন যে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসল। তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, পড়ুনআবার আমি বললাম, “আমি তো পড়তে জানি না তিনি আবার আমাকে চেপে ধরলেন।”


আমার দম বন্ধ হয়ে আসল। আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, ‘পড়ুনআমি তখনও বললাম, “আমি তো পড়তে জানি না ফেরেশতা তখন তৃতীয়বার আমাকে ঐ ভাবে চেপে ধরলেন, যার ফলে আমার সহ্য করা কঠিন হয়ে গেল। তখন তিনি ছেড়ে দিয়ে ইকরা বিসমি রাব্বিকা থেকে মা লাম ইয়ালামপর্যন্ত পড়ে শুনালেন।” এর পরের ঘটনা হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ীতে এসে হযরত খাদীজা (রা.)-কে বললেন, “আমাকে কম্বল দিয়ে ঢাককিছুক্ষণ কম্বল জড়িয়ে থাকার পর যখন ভয় দূর হলো, তখন তিনি বললেন, “খাদীজা, আমার কী হলো? তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর বললেন, আমার জীবনের ভয় ধরে গেছে।”


হযরত খাদীজা বললেন, ‘কক্ষনো নয়। আপনার খুশী হওয়া উচিত। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে কখনও অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করেন, সত্য কথা বলেন, আমানতের হিফাযত করেন, অসহায় লোকদের দায়িত্ব বহন করেন, গরীবদের অভাব দূর করেন, মেহমানদারী করেন এবং নেক কাজে হামেশা সাহায্য করেন এরপর হযরত খাদীজা (রা.) রাসূল (সা.)-কে ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে নিয়ে যান। ওয়ারাকা হযরত খাদীজা (রা.)-এর চাচাত ভাই ছিলেন। ওয়ারাকা হযরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারী ছিলেন এবং ইনজীলের বড় আলিম ছিলেন। সে সময় ওয়ারাকা খুব বৃদ্ধ ছিলেন, অন্ধও হয়ে গিয়েছিলেন। ওয়ারাকা সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন, “আরে! এতো ঐ ফেরেশতা, যিনি হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন


হায় আফসোস! আপনার নবুওয়াতের সময় আমি যদি জওয়ান হতাম। হায় আফসোস! আপনার দেশবাসী যখন আপনাকে তাড়িয়ে দেবে, তখন যদি আমি বেঁচে থাকতাম। রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “এরা আমাকে তাড়িয়ে দেবে? ওয়ারাকা বললেন, হাঁ, যে জিনিস আপনি এনেছেন, এ জিনিস নিয়ে এমন কোন লোক আসে নি, যার দুশমনী করা হয় নি। যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে সকল শক্তি দিয়ে আমি আপনার সাহায্য করব।এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ফেরেশতা আসার আগে কখনো রাসূল (সা.)- এর খেয়াল হয়নি যে, তিনি রাসূল নিযুক্ত হবেন। হঠাৎ করে ওহী নাযিল হওয়া ও এভাবে ফেরেশতার সাথে দেখা হওয়ার ফলে রাসূল (সা.)-এর যে অবস্থা হলো, তাতে একথা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তিনি এজন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই মাক্কাবাসীরা যতরকম আপত্তিই তুলুক, একথা কেউ বলতে পারে নি যে, এ লোক যে একটা কিছু দাবী করে বসবে, তা আমরা অনুমান করছিলাম


এ ঘটনা থেকে একথাও বুঝা যায় যে, নবুওয়াত লাভ করার আগে রাসূল (সা.)-এর জীবন কত পবিত্র ছিল এবং তাঁর চরিত্র কত উন্নত ছিল। হযরত খাদীজা (রা.) তখন ৫৫ বছরের অভিজ্ঞ মহিলা। এর আগে ১৫ বছর রাসূল (সা.)- এর বিবি হিসাবে তাঁকে অতি ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। স্ত্রীর কাছে স্বামীর কোন দোষই গোপন থাকতে পারে না। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তিনি রাসূল (সা.)- কে এত মহৎ মানুষ হিসাবে পেয়েছেন, যার ফলে হেরা গুহার ঘটনা শুনামাত্রই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মতো নেক লোকের কাছে আল্লাহর ফেরেশতাই এসে থাকবে


এমনিভাবে ওয়ারাকার মতো অভিজ্ঞ, ধার্মিক ও বযস্ক লোক রাসূল (সা.)- কে ছোট সময় থেকেই দেখে আসছিলেন। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসাবেও তিনি তাঁকে গভীরভাবে জানবার সুযোগ পেয়েছেন। হেরা গুহার ঘটনা শুনবার সাথে সাথেই তিনি বিনা দ্বিধায় ঐ মন্তব্য করলেন। রাসূল (সা.)-কে তিনি অতি উন্নত মানের মহাপুরুষ মনে করতেন বলেই তাঁর মনে কোন সন্দেহের উদয় হয় নি


সূরার দ্বিতীয় অংশ নাযিলের পরিবেশ : তখনও প্রকাশ্যে ইসলামের দিকে জনগণকে দাওয়াত দেয়া শুরু হয় নি। কিন্তু রাসূল (সা.)-কে কাবা শরীফে নামায আদায় করতে দেখে কুরাইশ সরদাররা পয়লা টের পেল যে, তিনি হয়তো নতুন কোন ধর্ম পালন করছেন। অন্য লোকেরা তো নামায দেখে খুবই বিস্মিত হলো। কিন্তু আবূ জাহেলের জাহেলী মন সহ্য করতে পারল না। সে ধমক দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে বলল যে, হারাম শরীফে এভাবে ইবাদাত করা চলবে না


আবূ জাহল কুরাইশদেরকে জিজ্ঞেস করল, “মুহাম্মদ কি তোমাদের সামনেই মাটিতে মুখ ঠেকাচ্ছে ? সবাই বলল, হাঁ, সে তখন বলল, ‘লাত ও ওযযার কসম, যদি তাকে এভাবে নামায পড়তে দেখি, তাহলে তার ঘাড়ের উপর আমি পা তুলে দেব এবং যমীনে তার মুখ ঘষে দেব।”  তারপর দেখা গেল যে, সে রাসূল (সা.)-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল যে, সে পেছনে হটে আসছে এবং হাত দিয়ে এমনভাবে তার মুখ ঢেকে নিচ্ছে যেন কোন কিছু থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কী হলো’? সে বলল, “আমার ও তার মাঝখানে আগুনের এক গর্ত ও ভয়ানক একটা জিনিস দেখলাম।” পরে রাসূল (সা.) বললেন, “যদি সে আমার কাছে পৌঁছত, তাহলে ফেরেশতারা তাকে টুকরা টুকরা করে উড়িয়ে দিত।”


আলোচনার ধারা

১. পয়লা আয়াতে প্রথম ওহী হিসাবে এটুকু জানানো হয়েছে যে, ইলম বা জ্ঞানের উৎস হলো আল্লাহ, যিনি সব কিছু পয়দা করেছেন। সৃষ্টিজগতে কার কী দরকার, কোন্টা কার জন্য ভাল এবং কিভাবে চললে সবার শান্তি হবে, এসব একমাত্র আল্লাহই জানেন তাই তাঁর নাম নিয়েই ইলম হাসিল করতে হবে। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকেই সহীহ ইলম পাওয়া সম্ভব। যে বিদ্যা আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের সাথে খাপ খায় না, তা আসলেই কুশিক্ষা।


২. দ্বিতীয় আয়াতে জানানো হয়েছে যে, মানুষকে কত নিকৃষ্ট অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ সুন্দর দেহবিশিষ্ট বানানো হয়েছে। তার মন-মগয তিনিই পয়দা করেছেন। মানুষ যেন ভুলে না যায় যে, বুদ্ধি ও জ্ঞান তিনিই দেন। তাই একটু বুদ্ধি হলেই শয়তান ও নাফসের ধোঁকায় পড়ে সে যেন নিজেকে আল্লাহর চেয়ে বড় মনে না করে এবং আল্লাহর দেয়া জ্ঞানকে অবহেলা করে যেন ধ্বংস ডেকে না আনে


৩. ৩-৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহান দয়াবান মনিব মানুষকে সামান্য রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করে ক্রমে সৃষ্টির সেরা মর্যাদা দিয়েছেন। সে মর্যাদা বহাল রাখতে হলে তাঁরই কাছ থেকে জ্ঞান নিতে হবে। ওহীর মারফতে তিনি যে জ্ঞান দান করেন একমাত্র ঐ জ্ঞানের মারফতেই মানুষ সত্যিকার মর্যাদার অধিকারী হতে পারে মানুষের প্রতি আল্লাহর এটা একটা বিরাট মেহেরবানী যে, কলমের মাধ্যমে লেখার বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে মানুষের জ্ঞানকে পরবর্তী যুগের লোকদের জন্য হিফাযত করার ব্যবস্থা করেছেন। লেখার বিদ্যা না জানলে অতীতের জ্ঞান হারিয়ে যেতো। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আজ মানুষ যে উন্নতি করেছে, তা সম্ভব হতো না। 


ভবিষ্যতে আরও উন্নতি এ কলমের কারণেই সম্ভব হবে। কলমের চর্চা না থাকলে কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানকেও সঠিকভাবে হিফাযত করা সম্ভব হতো না ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, ওহী দ্বারা আল্লাহ পাক ঐ ইলম দান করেছেন, যা চেষ্টা ও সাধনা করে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্যই রাসূল (সা.) যে ইলম পেয়েছেন, তা তাঁর গবেষণার ফল নয়, নিছক আল্লাহর দান। যে বিদ্যা মানুষ সাধনা ও গবেষণা করে পেতে পারে, তার জন্য নবী পাঠাবার দরকার হয় না। নবীর কাছে ঐ জ্ঞানই আসে, যা ওহী ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই


সূরার শুরুতে ইকরাবা পড়ুন বলা হয়েছে। এতে মনে হয় যে, জিবরাঈল (আ.) লিখিতভাবে একটি আয়াত রাসূল (সা.)-এর সামনে পেশ করেছিলেন। কিন্তু পড়তে না জানার ফলে পরে মুখে শুনিয়ে দিলেন। এরপর ওহী সব সময় তিলাওয়াত করেই রাসূল (সা.)-এর কাছে পৌঁছান হয়েছে। রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে কয়েকজন সাহাবা লেখার কাজ সমাধা করতেন। যখন যতটুকু নাযিল হতো, তখন ততটুকুই লিখে রাখা হতো, যাতে কোন অংশ হারিয়ে না যায় । এ দ্বারাও কলমের গুরুত্ব বুঝা যায়


৪. ৬-৮ আয়াতে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ায় আল্লাহ পাক মানুষকে ইচ্ছা ও চেষ্টার ক্ষেত্রে যেটুকু ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার ফলে মানুষ বেপরওয়া হয়ে চলে। আল্লাহ যে একদিন তাকে পাকড়াও করবেন, সে কথা সে ভুলে যায়। তাই সে বিদ্রোহী হতে সাহস পায়। কিন্তু সে যে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর কাছেই ফিরে যাচ্ছে, সে কথা সে খেয়াল করে না। আল্লাহ বিদ্রোহীদের কথা এখানে সাধারণভাবে বলার পর পরবর্তী আয়াতে বিশেষ করে আবূ জাহলের নাম উল্লেখ না করেই তার ধৃষ্টতা সম্পর্কে বলা হয়েছে


৫. ৯-১৪ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আবূ জাহল আল্লাহর রাসূলকে নামাযে বাধা দিচ্ছে অথচ রাসূলই ঠিক পথে আছেন এবং মানুষকে তাকওয়ার পথে চলার শিক্ষা দেন। আবূ জাহল কি জানে না যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন এবং সময় মতো গ্রেফতার করবেন?


৬. ১৫-১৮ আয়াতে আল্লাহ পাক আবূ জালকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন যে, যদি সে রাসূল (সা.)- কে নামায আদায়ে বাধা দেয়া থেকে বিরত না হয়, তাহলে তার মাথার চুল ধরে তাকে ফিরাব। তার সমর্থকরা তাকে রক্ষা করতে পারবে না হলোও তাই আযাবের ফেরেশতা তার সামনে দোযখের আগুন দেখিয়ে তাকে ঐ ধৃষ্টতা থেকে বিরত করল


৭. শেষ আয়াতে আল্লাহ পাক রাসূল (সা.)-কে অভয় দিয়ে বলেছেন যে, আবূ জাহলের পরওয়া না করে আপনি যেভাবে নামায আদায় করছিলেন, সেভাবেই করতে থাকুন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করুন আল্লাহ আপনার সাথেই আছেন

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

মোঃ মোবাশ্বের আলম কোরবান আমি একজন ইসলামিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।