সূরা আল-কাওসারের তাফসির 

আজকে আমরা আপনাদের জানাবো সুরা আল-কাওসারের তাফসির সম্পর্কে। সুরা আল-কাওসারের নাযিল এর সময়কাল। সুরা আল-কাওসারের বিষয়বস্তু। এই ব্যাপারে জানতে পোস্ট টি পড়ুন।

অগাস্ট 19, 2023 - 12:00
অগাস্ট 19, 2023 - 13:42
 0
সূরা আল-কাওসারের তাফসির 
সূরা আল-কাওসারের তাফসির | Image by Freepik

নাম: পয়লা আয়াতের কাওসার শব্দ থেকেই এর নাম রাখা হয়েছে।

নাযিলের সময়: এ বিষয়ে বিভিন্ন রিওয়ায়াতের দরুন যথেষ্ট মতভেদ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে সূরাটি মাক্কী যুগেই নাযিল হয়েছে। সূরার আলোচ্য বিষয় থেকেও বুঝা যায়, তখন ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আল্লাহ পাক তাঁর রাসূল (সা.)-কে সান্ত্বনা দেয়া দরকার মনে করেছেন। এ জাতীয় পরিবেশ মাক্কায়ই ছিল। তাই এ সূরাটি নিঃসন্দেহে মাক্কী


ঐতিহাসিক পটভূমি 

সূরা দোহা ও সূরা আলাম নাশরাহ সম্বন্ধে আলোচনায় দেখানো হয়েছে, নবুওয়াতের প্রথম দিকে যখন রাসূল (সা.) নিজের বংশের লোকদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন, তখন কেমন ধরনের বিরোধিতা দেখা দিয়েছিল রাসূল (সা.) এবং তার সামান্য কয়েকজন সাহাবীর ঐ অসহায় অবস্থায় আল্লাহ পাক সূরা দোহার ৩ ও ৪ নং আয়াতে সান্ত্বনা দিলেন যে, নিশ্চয়ই আপনার জন্য পরের অবস্থা আগের অবস্থার চেয়ে ভাল আসবে এবং শিগগিরই আপনার রব আপনাকে এতো দান করবেন যে, আপনি খুশী হয়ে যাবেন।


 সূরা আলাম নাশরাহ-এর ৪ থেকে ৬ নং আয়াতে আবার সান্ত্বনা দিলেন যেআমি আপনারই খাতিরে আপনার সুনামের কথা উঁচু করে দিয়েছি, নিশ্চয়ই প্রত্যেক মুশকিলের সাথে আসানী রয়েছেঅর্থাৎ আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন যে, দুশমনরা সারাদেশে আপনার বদনাম করার চেষ্টা করছে দেখে ঘাবড়াবেন না


আমি আপনার নাম উজ্জ্বল করার ব্যবস্থা করেছি। আর বর্তমানে পরিবেশ আপনার জন্য কঠিন দেখে পেরেশান হবেন না
, এ অবস্থা বেশী দিন থাকবে না। এমনি কঠিন পরিবেশেই সূরা কাওসারের মাধ্যমে একদিকে রাসূল (সা.)-কে সান্তনা দেয়া হয়েছে, অপরদিকে তার দুশমনদেরই লেজ কাটা যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে। সে সময় পরিবেশ কিরূপ নৈরাশ্যজনক ছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসেই রয়েছে


কুরাইশ সরদাররা বলতো, “সে তো গোটা জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একঘরে হয়ে গেছে এবং তার কোন সঙ্গী-সাথী ও সহায়ক নেই।” তারা আরো বলতো, “সে তো শিকড়-কাটা গাছের মতো শুকিয়ে শেষ হয়ে যাবে।” মাক্কার সরদার আস বিন ওয়ায়েল বলতো, “সে তো জড়-কাটা এক লোক, তার কোন ছেলে সন্তান নেই, মরে গেলে তার নাম নেবারও কেউ থাকবে নারাসূল (সা.)-এর বড় ছেলে কাসিম (রা.) পয়লা ইন্তিকাল করেন।


পরে ছোট ছেলে আবদুল্লাহ (রা.)-ও যখন ইন্তিকাল করলেন
, তখন রাসূল (সা.)-এর আপন চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী আবূ লাহাব খুশী হয়ে দৌড়ে যেয়ে এ খবরটাকে একটা সুসংবাদ হিসাবে ছড়াতে ছড়াতে বললো, “আজ রাতে মুহাম্মদ নিঃসন্তান হয়ে গেল, তার শিকড় কেটে গেল


এ অবস্থায় রাসূল (সা.)-এর মনে কতটা ব্যথা বোধ হওয়ার কথা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। একদিকে তাওহীদের দাওয়াত দেবার পরে মুশরিক কুরাইশদের কাছে তিনি হেয় হয়ে গেলেন। বংশের সেরা সম্মানিত বলে যিনি সমাদর পেতেন, তিনি বংশের কলংক বলে চিহ্নিত হলেন


অপরদিকে যে কজন লোক তার সাথী হয়েছিলেন, তাদেরকেও সমাজচ্যুত করে মারপিট করতে লাগলো । এরপর একে একে সব পুত্র সন্তানের ইন্তিকালে যখন পাড়া-প্রতিবেশী ও দূরের আত্মীয়দের কাছ থেকে শোক জ্ঞাপন ও সহানুভূতি প্রদর্শনের পরিবর্তে আপন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা পর্যন্ত উৎসব পালন করতে থাকলো, তখন রাসূল (সা.)-এর মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব


সূরা কাওসার আল্লাহ পাকের ঐ উপলব্ধিরই প্রমাণ। আল্লাহ নিজেই যাকে ইসলামী আন্দোলনের কঠিন ময়দানে নামিয়ে দিয়েছেন, তার আপদ-বিপদ ও দুঃখ-বেদনায় তিনি ছাড়া আর কে সান্ত্বনা দেবে ? সূরা কাওসার সে সান্ত্বনার সওগাত নিয়েই হাযির হয়েছে। এ সূরাটি কুরআনের সবচেয়ে ছোট্ট সূরা। কিন্তু এর মধ্যে রাসূল (সা.)-এর জন্য এমন মহা সুসংবাদ রয়েছে, যা আর কোন মানুষকে কোন কালেই দেয়া হয়নি। সাথে সাথে একথাও ঘোষণা করা হয়েছে যে, যারা রাসূল (সা.)-এর বিরোধিতা করছে আসলে তারাই জড়-কাটা ও শিকড়-ছেঁড়া বলে প্রমাণিত হবে


আলোচনার ধারা

 . এ সূরা নাযিলের সময়কার নৈরাশ্যজনক যে করুণ বিবরণ ঐতিহাসিক পটভূমিতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর ফলে রাসূল (সা.) শোক-দুঃখ ও ব্যথা-বেদনার যে মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, সে অবস্থায় মাত্র ১০টি শব্দের ছোট্ট এ সূরাটির পয়লা তিনটি শব্দে আল্লাহ পাক যেন দুনিয়া ও আখিরাতে সমস্ত নিয়ামাত তাঁর প্রিয় বান্দার উপর ঢেলে দিলেন নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি' বলে আল্লাহ পাক যেন এক কথায়ই সবকিছুই দিয়ে দিলেন। কোন ভাষায়ই এক শব্দে কাওসার শব্দটির তরজমা পেশ করা সম্ভব নয়। সব রকম কল্যাণ ও মঙ্গল এবং অফুরন্ত নিয়ামাতের প্রাচুর্য এ একটা শব্দেই বুঝাচ্ছে। 


ভবিষ্যতে কাওসারদেয়া হবে বলে এখানে বলা হয়নি। বরং নিশ্চিত করে বলা হয়েছে যে, কাওসার দেয়া হয়ে গেছে। এ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দুশমনরা ধারণা করেছিল যে, 'ইসলামী আন্দোলনের কারণে রাসূল (সা.)-এর ব্যবসা-বাণিজ্য খতম হয়ে গেছে। সমাজে তিনি একঘরে হয়ে আছেন অসহায় সঙ্গী-সাথীরাও নির্যাতিত ও আধমরা অবস্থায় আছে। ছেলেরাও মরে গেলো। এ অবস্থায় বেচারা দুনিয়া থেকে চলে গেলে এর নাম নেবার জন্যও আর কেউ থাকবে না


এর জওয়াবে সামান্য এক কাওসার শব্দে আল্লাহ পাক পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন যে
, “হে আমার প্রিয় বান্দা, আমি আপনাকে নবুওয়াতের মর্যাদা দিয়েছি, চরিত্রের অতুলনীয় সম্পদ দিয়েছি, কুরআন, ইলম ও হিকমাত দান করেছি এবং মানব জাতির উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য জীবন বিধান দিয়েছি


এসবের কারণে কিয়ামাত পর্যন্ত আপনার উম্মতের মাধ্যমেই মানব জাতি কল্যাণের পথ পেতে থাকবে। আর কিয়ামাতের পর হাশরের ময়দানে যখন সব মানুষ পিপাসায় কাতর হবে, তখন হাউজে কাওসার আপনারই দায়িত্বে থাকবে এবং আপনি যাদেরকে এ হাউজ থেকে পানি পান করাবেন, তারা ছাড়া আর কেউ সেদিন পানি পাবে না এ পানি বেহেশতের হাউজে কাওসার থেকেই হাশরের ময়দানে প্রবাহিত হবে। হাশরের পর যখন আপনি জান্নাতে যাবেন, তখনও সেখানকার হাউজে কাওসার আপনারই হাতে থাকবে। 


এসব নিয়ামাতই আপনাকে দিয়ে দিলাম। হাউজে কাওসারের পানি সম্বন্ধে হাদীসে বিস্তর আলোচনা আছে বলা হয়েছে যে, সে পানি দুধ, বরফ ও রূপা থেকে বেশী সাদা, বরফ থেকে ঠান্ডা ও মধু থেকে মিষ্টি। এর নীচের মাটি মিসক আতর থেকে বেশী সুগন্ধি। যে এ পানি পান করবে, তার আর পিপাসা হবে না, আর যে এ পানি থেকে বঞ্চিত হবে, অন্য কিছুতেই তার পিপাসা মিটবে না


. দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, আপনার দুশমনদের বেদনাদায়ক কথাবার্তা গায়ে মাখবেন না । আপনার সম্পর্কে তাদের মন্তব্যে মন খারাপ না করে আপনার রবের দেয়া দায়িত্ব পালন করতে থাকুন


. শেষ আয়াতে রাসূল (সা.)-কে শান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে যে, যারা আপনাকে লেজ-কাটা বা জড়-কাটা বলছে, তারাই আসলে এসব উপাধি পাওয়ার যোগ্য। কিছুদিন সবর করুন দেখবেন যে, আপনার দুশমনরা কিভাবে পরাজিত হয় এবং এবং চিরদিনের জন্য মানব জাতির নিকট ঘৃণ্য হয়ে থাকে


বিশেষ শিক্ষা

ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি আসল সম্পদ নয়। দুনিয়ায় আল্লাহর মরযী মতো কাজ করে আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করাই আসল কামিয়াবীকুরাইশ সরদাররা রাসূল (সা.)-এর কোন পুত্র-সন্তান না থাকার ফলে মনে করেছিল যে, তিনি দুনিয়া থেকে চলে গেলে তার নাম নিশানাও মিটে যাবে। তারা নিজেদের হিসাব অনুযায়ীই এ ধারণা করেছিল কিন্তু এ কথাই চির সত্য যে, মানুষ কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। পরবর্তী বংশধরদের মাধ্যমে কারো নামটুকু শুধু কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু যিনি মহৎ ও বড় কোন কাজ করে যান, তাকে গোটা মানব জাতি চিরদিন মনে রাখে। এসব লোকের মৃত্যু নেই


রাসূল (সা.)-এর কোন ছেলে না থাকায় রক্তের দিক দিয়ে তার বংশ বাড়ে নি। কিন্তু তাঁর রূহানী সন্তান দুনিয়ার সব জায়গায় পাওয়া যায়। কোটি কোটি মানুষ রাসূল (সা.)-কে যেভাবে মহব্বত করে এবং তাঁর জন্য যে আবেগ বোধ করে, আর কোন মানুষের বেলায় কি এমন হয়? যারা রাসূল (সা.)-কে লেজ-কাটা বলে মনে করেছিল, তাদেরকে ধিক্কার দেয় না এমন মানুষ কি দুনিয়ায় আছে? এমন কি যারা আজ আবু জাহল ও আবু লাহাবদের ভূমিকা পালন করছে, তারাও এদেরকে ধিক্কারই দিয়ে থাকে। তাই এরাই আসলে লেজ-কাটা

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

মোঃ মোবাশ্বের আলম কোরবান আমি একজন ইসলামিক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।