নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে চারশো বছরের পুরনো মীর জুমলার গেট
মীর জুমলার গেট বা ঢাকা গেট নামেই পরিচিত এই ফটকটি। ঢাকা নগরীর সাড়ে তিনশ বছরের ইতিহাসের স্মারক পলেস্তরা খসা জীর্ণ-শীর্ণ ওই ফটকটি। আর কিছুদিনের মধ্যেই অযত্ন এবং অবহেলায় ধ্বংসের মুখে থাকা ফটকটির মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল ছুটবে।

পর্যটকরা দিল্লিতে গেলে দিল্লি গেট, প্যারিসে গেলে আর্ক-ডি-ট্রায়াম্ফ কিংবা বার্লিনে গেলে ব্যান্ডেনবুর্গ গেট দেখার জন্য ছুটে যান। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেও যে একটি ফটক আছে সে কথা ক’জনেই বা মনে রেখেছে! ক’জনেই বা তার ইতিহাস জানে অথবা গল্প করে!
এই ফটক ইতিহাসের স্মৃতি জড়ানো এক ফটক। কেউ কেউ জানলেও অনেকেই তার ইতিহাস ভুলে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি অভিমুখী সড়কের দু’দিকে তাকালেই এই ফটক দেখা যায়। দেখা যায় লতাপাতা ঘেরা বিবর্ণ দুটি স্থাপনা।
ঢাকা গেট
বিশাল ওই অবকাঠামোর নিচে এখন সেই ঢাকা গেটকে খুঁজে পাওয়াই ভার। আজ সেই ঐতিহাসিক মীর জুমলা ফটক সম্পর্কেই আপনাদের জানানোর চেষ্টা করবো।
মীর জুমলা ফটক
অপর এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, ইসলাম খাঁর আমলে বাগে বাদশাহী নামে এক মুঘল উদ্যান ছিল এই রমনা অঞ্চলে। সেই বাগে বাদশাহীর প্রবেশপথেই ছিল দুটি স্তম্ভ। এবং পরে তা পুনর্নির্মাণ করে ময়মনসিংহ গেট নামকরণ করা হয়।
মীর জুমলার গেট নামকরণ
সাধারণ মানুষের কাছে এটি রমনা গেট নামেই পরিচিতি পায়। কারণ মীর জুমলার এই গেট রমনায় প্রবেশ করার জন্য ব্যবহার করা হতো বলে একে সাধারণ জনগণ রমনার গেট বলে। কিন্তু এই গেট বা তোরণ এবং এর আশেপাশের জায়গার নাম বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুসারে দেওয়া হয়েছে ‘মীর জুমলার গেট’।
ঐতিহাসিক স্থাপনা
তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি রাস্তা তৈরি করেন। এ রাস্তার প্রবেশমুখে এ দুটি স্তম্ভ তৈরি করেন ডস। যা এখনও অটুট রয়েছে।
শুধু তাই নয় ঢাকার বর্তমান নজরুল এভিনিউর রাস্তাটিও ডস তৈরি করেন। “বাগে বাদশাহী” নামে মুঘল উদ্যানটি ইসলাম খাঁর আমলে ছিল রমনা অঞ্চলে।
একই ধরণের দুটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রবেশপথ ছিল হাইকোর্ট ভবনের পূর্ব কোণে। মূলত সে সময় হাতির চলাচল ছিল এ স্তম্ভের মধ্য দিয়ে।
মীর জুমলার গেট এর গঠন
প্রায় ২০ ইঞ্চি চওড়া উঁচু থেকে নিচুতে নামা এ দেয়ালটি। কিন্তু পূর্ব পাশের বড় স্তম্ভের সঙ্গে কোনো ছোট স্তম্ভ নেই। আছে শুধু দেয়াল বা প্রাচীর।
সময়কাল নিয়ে দ্বন্দ্ব
তবে এ ধারণার সঙ্গে একমত নন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। তার ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী ঢাকা’ নামক একটি গ্রন্থ আছে। সেখানে তিনি দাবি করেন যে, ১৯২৫ সালের পর ব্রিটিশ আমলে ঢাকার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ড’স রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করেছিলেন রেসকোর্স।
আর এই রেসকোর্সকে মূল শহরের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য রেসকোর্সের উত্তর পূর্ব দিকে ড’স তৈরি করেছিলেন একটি রাস্তা। রাস্তার প্রবেশমুখে তৈরি করেছিলেন দুটি স্তম্ভ। প্রচলিত মত অনুসারে এ দুটি স্তম্ভের নাম, মীর জুমলার গেট।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, এই মীর জুমলা গেট মুঘল আমলেই নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে উপমহাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও এমিরিটাস অধ্যাপক ড. এ এইচ দানী এই ফটকের গড়ন সম্পর্কে বলেন। তিনি বলেন যে, এর গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচের।
কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক একেএম শাহনেওয়াজ মনে করেন মীর জুমলার গেটটি মুঘল আমলেই তৈরি করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি সংবাদপত্রে বলেন যে, ঢাকার সীমানা শুধু এতটুকুই ছিল না। এটি আরও বড় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে। আর সেই সময়েই সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। শাহবাগ হয়েছে নবাবদের আমলে। ঔপনিবেশিক আমলে হলে এই মীর জুমলার গেট হত আরও উত্তরে।
তিনি আরও বলেন যে, তখন যদি এই ফটক নির্মাণ করা হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাবে এর সামনে এবং পেছনে দুই দিকেই শহর। আর মাঝখানে হত গেট। কিন্তু শহরের মাঝখানে তো গেট হওয়ার কথা নয়। গেট তো হয় শহরের প্রবেশ পথে।
এছাড়া কলোনিয়াল পিরিয়ডে এইসব গেট দিয়ে আলাদা করার প্রবণতা দেখা যায় না। এই গেট করা প্রবণতা ছিল মুঘল আমলেই।
মীর জুমলার গেট এর ধ্বংসাবশেস
আরেকটি অংশ পূর্ব দিকে পড়েছে। যা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার সমাধির প্রবেশপথের সামনে এবং মাঝের অংশটি পড়েছে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসিগামী সড়ক দ্বীপে। তবে মেট্রোরেল এই মীর জুমলার গেট দিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। এই মেট্রোরেলটি শাহবাগ দিয়েও নিতে পারত। কারণ এখানে আছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। আর এই মেট্রোরেলটির কারণে সেগুলোর সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে।
তিনি বলেছেন, যেহেতু মেট্রোরেলটি করে ফেলছে সেহেতু এখন আর কিছুই করা নেই। তবে ঐতিহাসিক স্থাপনা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। মেট্রোরেল সড়কের কারণে ঢাকা গেট এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক শাহনেওয়াজ।
তিনি বলেন যে, একশ বছরের বেশি পুরনো স্থাপনাকে প্রত্মতত্ত্ব আইন অনুযায়ী বলা হয় হেরিটেজ। সুতরাং এটা আমাদের হেরিটেজ। তাই এটা রক্ষার দ্বায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে দেওয়া উচিত।
পরিশেষ
নতুন প্রজন্মের জন্য হয়তো ঐতিহ্যের শেষ স্মৃতিটুকুও আর ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাই আমাদের উচিত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর প্রতি যত্নশীল হওয়া। এগুলো আমাদের দেশের ঐতিহ্য। যা এই দেশের ইতিহাসকে বহন করে।
আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। আর আপনিও আপনার লেখাগুলো দি ব্যাকস্পেস জার্নাল -এ প্রকাশ করতে পারেন। এজন্য দ্রুত লগ-ইন করে ফেলুন দি ব্যাকস্পেস জার্নাল এ। ধন্যবাদ।
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?






