ইতিহাসে ৮ জন সুন্দরী নারীর আবির্ভাবের পেছনের গল্প

ইতিহাস নিয়ে সবার রয়েছে কৌতূহল। সেকালের রাজা-রাণীদের নিয়ে কৌতূহল সবার মনে রয়েছে বৈ কি। তাই ইতিহাস ঘাঁটলেই ক্লিওপেট্রা, এলিজাবেথ ও মেরিসহ বিখ্যাত নারীদের কথা সামনে আসে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ইতিহাসের বুকে স্থান পেয়েছেন তাঁরা।

জুল 19, 2023 - 10:00
জুল 19, 2023 - 00:40
 0
ইতিহাসে ৮ জন সুন্দরী নারীর আবির্ভাবের পেছনের গল্প
ইতিহাসে ৮ জন সুন্দরী নারীর আবির্ভাবের পেছনের গল্প | Image Source: NightCafe Creator

ইতিহাস নিয়ে সবার রয়েছে কৌতূহল। সেকালের রাজা-রাণীদের নিয়ে কৌতূহল সবার মনে রয়েছে বৈ কি। তাই ইতিহাস ঘাঁটলেই ক্লিওপেট্রা, এলিজাবেথ ও মেরিসহ বিখ্যাত নারীদের কথা সামনে আসে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ইতিহাসের বুকে স্থান পেয়েছেন তাঁরা।


ছাড়া নিজেদের সৌন্দর্য দিয়েও আজ বিশ্ববাসীকে আকর্ষিত করছেন তাঁরা। বর্তমান নারীরা তাদের সৌন্দর্য্য রহস্য অনুসরণ করে থাকে তবে জানেন কি? কতোটা অদ্ভুত আর ভয়াবহ ছিল তাদের রুপচর্চার ধরণ?


ইতিহাসের সেরা ৮ সুন্দরী নারীর রুপের আড়ালের কাহিনী


১. সিমোনেত্তা ভেসপুচ্চি

তালিকা প্রথমেই যে নারীর পরিচয় করে দিতে যাচ্ছি আপনাদের সাথে তার নাম হয়তো আপনি আগে কখনো শুনে নাও থাকতে পারেন। মাত্র ২২ বয়সেই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমানোর আগে তাকে সবাই ইতালীর সেরা সুন্দর নারী মনে করতেন। এই সৌন্দর্যের কারনেই বত্তিচল্লি সহ ফ্লোরেন্সের চিত্রশিল্পীরই চিত্রের মডেল হয়েছিলেন এই তরুণী।


বত্তিচল্লির ১৪৮০ দশকের মাঝমাঝি সময় অস্কিত দ্য বার্থ অফ ভেনাস চিত্রকর্মের মাঝখানে ভেনাসরুপে দাঁড়ানো নারী আর কেউ নন, স্বয়ং ভেসপুচ্চি ছিলেন। তিনি মডেল হিসাবে ছিলেন। আজকাল আমরা যেমন কোনো মডেল কে দেখি তার অনুকরন করার চেষ্টা করি। সে সময় ইতালীর নারীরা ফ্যাশনে জন্য তার অন্ধ অনুকরন করতেন। চেহারাকে ধূসর, সাদা ও সৌন্দর্য্য করার জন্য ভেসপুচ্চির সময়ের নারীরা মুখে জোঁক লাগিয়ে রাখতেন। জোঁকেরা তাদের রক্তচুষে নিতো। ফলে রক্তহীনমুখ ফ্যাকাশে হত এটাই তারা চাইতেন।


আর যারা জোঁক লাগাতে ভয় পাইতো তারা পাউরুটির সাথে ডিমের সাদা অংশ এবং ভিনেগার
মিশিয়ে মাস্ক লাগাতেন। ভেসপুচ্চি জন্মগত ভাবে ছিলেন স্বর্ণকেশী। অনেকে তার মত চুল করতে চাইতেন। যারা দরিদ্র ছিলেন তারা চুলকে সোনালী করার জন্য নিজেদের মূত্রই ব্যবহার করতেন।


২. সম্রাজ্ঞী জো পোরফাইরোজেনিটা

জো পোরফাইরোজেনিটাকে বলা হয়ে থাকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অন্যতম সেরা সুন্দরী সম্রাজ্ঞী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই জো-ই যখন তরুণী ছিলেন, তখন নাকি তিনি দেখতে ততটা আকর্ষণীয় ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন তার বয়স ষাটোর্ধ্ব হয়ে যায়, তখন নাকি তাকে দেখতে এতটাই সুন্দর লাগতো যে, মনে হতো কোনো তরুনী হেঁটে যাচ্ছে।


আসলেই এটা সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু কীভাবে তিনি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন, সেই বিষয়েই এখন বলা যাক।


বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, টাকা হলে বাঘের দুধও মেলেঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিলো জো’র বেলায়। সম্রাজ্ঞী হবার পরে শুধুমাত্র তার রুপচর্চার উদ্দেশ্যেই রাজপ্রাসাদের ভেতরে একটি আস্ত কসমেটিক্সের গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়। এখানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো যেমন বেশ দামী ছিলো, তেমনই ব্যয়বহুল ছিলো এখান থেকে উৎপাদিত প্রসাধনী সামগ্রীগুলোও। তবে, রাণীরর জন্য নিবেদিত গবেষণাগার বলে কথা, এই প্রসাধনী সামগ্রীগুলোর একমাত্র ক্রেতা ছিলেন জো নিজেই।


৩. লুক্রেজিয়া বর্জিয়া

পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের কন্যা লুক্রেজিয়া বর্জিয়া ছিলেন বিখ্যাত হাউজ অ বর্জিয়ার এক অভিজাত বংশীয় নারী। মোহনীয় রুপের জন্য অসংখ্য চিত্রকর্ম, উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে তাকে। তার রুপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল তার চুলগুলো।


আর সেসবের রক্ষণাবেক্ষণে তার যে পরিমাণ সময় ও শ্রম দেয়া লাগতো, তা জানলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। বর্জিয়ার চুলগুলো ছিল বেশ উজ্জ্বল ও সোনালী বর্ণের। তবে একটু আগেই আলাপ করা ভেসপুচ্চির মতো তিনি জন্মগতভাবে স্বর্ণকেশী ছিলেন না। তার পরিবারের অন্য সবার চুলই ছিলো ঘন কালো রঙের। তবে বর্জিয়ার পছন্দ ছিলো সূর্যের আলোয় চকচক করে ওঠা সোনালী চুল।


এজন্য লেবুর রস ও একপ্রকারের ক্ষারের সাহায্যে নিজের চুলগুলোকে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগিয়ে ধুতেন তিনি। পরে দিনের বাকি সময় ধরে আবার সূর্যালোকের বসেই চুলগুলো শুকানো লাগতো। তার এই চুলের পরিচর্যায় এতটাই সময় যেত যে, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে তাকে শুধুমাত্র চুলের যত্নের জন্য।


তার সহচরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন চিঠি আজও টিকে আছে। সেসব চিঠিতে তাকে বিভিন্নজনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা গেছে এই বলে যে, তার যেতে কয়েকদিন সময় লাগবে, কারণ কাপড়গুলো গোছাতে হবে এবং মাথা পরিষ্কার করতে হবে।


৪. রানী প্রথম এলিজাবেথ

রানী প্রথম এলিজাবেথের সময়কালে সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রসাধনী সামগ্রীটির নাম ছিলো ভেনেশিয়ান সেরুজ। সীসা ও ভিনেগার মিশিয়ে প্রস্তুতকৃত এ প্রসাধনীটি তৎকালীন নারীরা তাদের মুখে ব্যবহার করতেন, যাতে তাদেরকে আরো ফর্সা দেখা যায়।


ভেনেশিয়ান সেরুজ ব্যবহারের দিক দিয়ে তৎকালীন অন্য সকল নারীকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন রাণী। তার বয়স যখন ২৯ বছর, তখন তিনি স্মলপক্সে আক্রান্ত হন। ফলে তার সারা শরীর গুটি গুটি দাগে ছেয়ে যায়। এ অবস্থায় অন্য কারো সামনেই যাবার মতো অবস্থা ছিলো না রানীর। তাই জনসমক্ষে যাবার আগে প্রতিবার তিনি শরীরের বাইরে প্রদর্শিত প্রতিটি অংশ ভেনেশিয়ান সেরুজ দিয়ে মাখিয়ে নিতেন।


তিনি সেই মিশ্রণটি এতটাই বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতেন যে, কেউ যদি তাকে মেকআপ ছাড়া দেখতো, তবে সেই ব্যক্তি তাকে ভুলেও চিনতে পারতো না!


৫. মেরি আঁতোয়ানে

ফরাসি বিদ্রোহের আগে মেরি আঁতোয়ানেই ছিলেন ফ্রান্সের সর্বশেষ রানী। ঘুমোতে যাবার আগে এই রানী ফেসমাস্ক হিসেবে যা ব্যবহার করতেন, সেটার উপকরণগুলোর নাম শুনে কেউ সেটাকে খাবার বলে ভাবলেও খুব একটা ভুল হবে না। কারণ সেই মিশ্রণে থাকতো কনইয়াক মদ, ডিম, গুঁড়া দুধ এবং লেবুর রসের উপস্থিতি।


সকালে ঘুম থেকে উঠে রানী যে ফেস ক্লিনার ব্যবহার করতেন, তা বানানো হতো কবুতর সিদ্ধ করা পানি দিয়ে। সেই বোতলগুলোর লেবেলে লেখা থাকতো ‘Eau Cosmetique de Pigeon’ এবং আরো জানানো থাকতো যে, প্রতিটি বোতলের মিশ্রণ তৈরিতে ৮টি করে কবুতর ব্যবহার করা হয়েছে!


এরপর আসতো পোষাক বদলের বিষয়, যা দিনে তিনবার করে করতেন রানী। একজন রানী হওয়ায় কখনোই এক পোষাকে দ্বিতীয়বার দেখা যেত না তাকে। এভাবে করে তার পোষাকের পেছনে বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হতো, বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী তা দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলারে!


ধারণা করা হয়, তৎকালে ফ্রান্সে শিরাকে নীল রঙে রাঙানোর জনপ্রিয় ফ্যাশনের একজন অনুসারীও ছিলেন রানী মেরি। সেই সময় ফ্রান্সের নারীদের মাঝে কে কতটা কৃশকায় হতে পারে তা একটা ফ্যাশনে রুপ নিয়েছিল। তারা নিজেদের শিরাগুলোকে নীল রঙের পেন্সিল দিয়ে এঁকে বোঝাতে চাইতেন যে, তারা এতটাই শুকনা যে তারা আলোকভেদ্য হয়ে গিয়েছেন। আর এ সবই করা হতো পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য।


৬. ক্লিওপেট্রা

ক্লিওপেট্রা নাম ইতিহাসে অনেকে শুনেছেন। আজ তার কথা বলা হবে। তৎকালে মিশরে নারীরা যে লিস্টিক ব্যবহার করতেন, তা তৈরিতে ব্যবহার করা হতো গুবরেপোকার চূর্ণ করা অন্ত্র। আর চোখের নিচে তারা লাগাতেন কুমিরের শুকনো মলের চূর্ণ। একজন নারী হিসেবে ক্লিওপেট্রাও এসব ব্যবহারের বাইরে ছিলেন না।


তবে, যত যা-ই হোক না কেন, ক্লিওপেট্রা তো একজন রানী। তাহলে তিনি কেন কেবল সাধারণ নারীদের কাতারে নিজেকে আটকিয়ে রাখবেন? তার রুপচর্চা পুরো ব্যাপারটিই ছিলো রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার।


গোসলের জন্য ক্লিওপেট্রা ব্যবহার করতেন টক
হয়ে যাওয়া গাধার দুধ। তার চাকর-বাকরেরা প্রতিদিন ৭০০ গাধার দুধ দোয়াতো। এরপর সেই দুধ দিয়ে পূর্ণ করা হতো বিশালাকার এক পাত্র। সেই দুধ টক হয়ে গেলেই কেবল ক্লিওপেট্রা তাতে গোসলে নামতেন। তার বিশ্বাস ছিলো, এর ফলে চামড়ার ভাঁজ দূর হয়।


শুনতে যতই অদ্ভুত লাগুক না কেন
, ক্লিওপেট্রার এই গাধার দুধ কিন্তু আসলেই তার চামড়ার সুরক্ষায় কাজে আসতো। টকে যাওয়া ল্যাকটোজ ধীরে ধীরে ল্যাক্টিক এসিডে পরিণত হয়। এটা চামড়ার উপরিভাগের অংশকে ঝরিয়ে ফেলে। ফলে বেরিয়ে আসে তুলনামূলক কোমল, দাগহীন নতুন চামড়া।


৭. মেরি কুইন অফ স্কটস

রানী মেরি জন্মগতভাবে অতটা সুন্দরী ছিলেন না। কারণ তার নাকটা ছিলো স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা লম্বাটে গড়নের, আর চিবুকটাও ছিলো সূক্ষ্মাগ্রবিশিষ্ট। কিন্তু তিনি রানী বলে কথা। তাকে যে মোহনীয় রুপের অধিকারী হতেই হবে!


নিজের চেহারাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবার জন্য মেরির নির্দেশে একদল চাকরবাকর বাথটাব পূর্ণ করতো হোয়াইট ওয়াইন দিয়ে। এরপর তাতেই গা ভেজাতেন রানী, মনে করতেন, উন্নতি হচ্ছে তার রুপের।


ওয়াইনের মাধ্যমে রুপচর্চার বিষয়টি যদি আপনার কাছে অদ্ভুত লাগে
, তাহলে আপনাকে আরো একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো। রানী মেরির অনুসৃত এই রুপচর্চার পদ্ধতিটি এখনও বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রচলিত আছে, যা ভাইনোথেরাপি নামে পরিচিত।


রানী তার বাথটাবের সেই মিশ্রণে কী কী উপাদান মেশাতেন তা জানা না গেলেও আধুনিককালের ভাইনোথেরাপিস্টগণ পানযোগ্য, অ্যালকোহল জাতীয় ওয়াইন ব্যবহার করেন না। বরঞ্চ ওয়াইন বানানো হয়ে গেলে সেখান থেকে প্রাপ্ত অবশেষই তারা ভাইনোথেরাপিতে ব্যবহার করেন, যাতে কোনোরুপ নেশার উদ্রেক হয় না।


৮. নেফারতিতি

এবার একটু মিশরের দিকে যাওয়া যাক। ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, অথচ মিশরের রানী নেফারতিতির নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। তার নামের অর্থ ছিলো সৌন্দর্যের আগমন। আর নামের সাথে যেন তার রুপের সত্যিকার অর্থেই মিল ছিলো।


নিজের রুচর্চার জন্য নেফারতিতি প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করতেন, সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও তার কবরটি খুঁজে পাওয়া যায় না, তবে তার সমসাময়িক কালের অন্যান্য ধনী নারীদের ব্যবহৃত প্রসাধনী সামগ্রী আমাদেরকে তার রুপচর্চার পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণাই দেয়।


নেফারতিতির মাথায় কোনো চুলই ছিল না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার পুরো দেহের চুলই কামিয়ে ফেলা হয়েছিলো। চুলের জায়গায় তিনি পরচুলা ব্যবহার করতেন। আর চোখে ব্যবহার করতেন সীসার আকরিক গ্যালেনা থেকে প্রস্তুতকৃত সুর্মা।


তিনি যে লিপস্টিক ব্যবহার করতেন, সেটার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো বিষাক্ত ব্রোমিন ম্যানাইট, যা তার স্বাস্থ্যহানীর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow