পুতুল এর বাড়ি (A Doll's House) এই নাম শুনে সবার আগে কি মনে পড়ে? একটা বাড়ি যেখানে সব পুতুল। একদম মানুষ এর সংসারের মত পুতুল এর একটা সংসার, তাই না?
আজকাল মানুষ আর মানুষ হিসেবে বাঁচে কম; পুতুল হয়ে বাঁচে বেশি। সবাই সবার পুতুল হয়ে। সন্তান বাবা মা এর পুতুল হয়ে, প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের পুতুল হয়ে, স্বামী স্ত্রীর হাতের পুতুল হয়ে আবার কখনো বা স্ত্রী স্বামী’র পুতুল হয়ে।
‘A Doll's House’ নাটকের নোরা আপাতদৃষ্টিতে বলতে গেলে তার স্বামী এর হাতের পুতুল। নোরা ছোট থেকেই পুতুল। প্রথমে ছিল তার বাবার, এরপর টরভাল্ডের হাত এর পুতুল তার সাথে বিয়ে হওয়ার পর। তার চিন্তা-চেতনা, কথা-বার্তা, খাওয়া-দাওয়া, পরিধেয় পোশাক, পরিবারের সিদ্ধান্ত সব কিছুই তার স্বামী এর হাতে।
নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই তার। নোরা কে বিভিন্ন ভাবে খোঁচা মেরে কথা বলাটা টরভাল্ডের নোরার প্রতি ভালবাসার এক নির্মম পরিহাস। নাটকে যদিও নোরার পুতুল হয়ে থাকার ব্যাপারটা খুব নির্মমভাবে ফুটে উঠেছে কিন্তু শেষ এ নোরার নিজেকে আবিষ্কার করা, সব দ্বিধা ফেলে সব কিছু ছেড়ে যাওয়াটা পাঠক কে যেমন খুশি করে তেমন অবাক করে দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কি এই পুতুল বাড়িতে শুধু নোরাই পুতুল?
নোরার স্বামী, টরভাল্ড, যিনি মনে করেন নোরা তার হাতের পুতুল। শেষ এ দেখা যায় আদতে তিনিও পুতুল। নোরার হাত এর পুতুল তিনি। নোরা বাইরে বাইরে টরভাল্ড যেমন ভাবে তাকে দেখতে চান সেভাবেই নিজেকে সাজিয়ে রাখেন।
একটা ছদ্মবেশ বলা যেতে পারে নোরার এই রূপ কে যা শুধুমাত্র টরভাল্ড কে খুশি রাখার জন্য বা টরভাল্ড কে একটা বুঝ দেয়া যে নোরা কে টরভাল্ড তার খুশি মত কন্ট্রোল করতে পারে। নোরা যে টরভাল্ড কে না জানিয়ে টাকা ধার নেয় এবং সেটা তার অগোচরে পরিশোধ করতে থাকে এর সাথে আবার তার বাবার সাইন নকল করা এসব কিছু প্রমাণ করে নোরা কতটা বোকা বানাতে সক্ষম তার স্বামী কে।
নোরা কে বোকা, পুতুল ভাবা টরভাল্ড ভাবতেই পারে না আসলে নোরা একটা ছদ্মবেশ পড়ে আসলে টরভাল্ড কে পুতুল করে রাখছে নোরা। নোরা পুতুল ইচ্ছে করেই হয়ে থাকে টরভাল্ড এর কাছে সাংসারিক শান্তি, ভালবাসার এর জন্য।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে নোরা বিদ্রোহ করে প্রায়-ই। আর এই বিদ্রোহ কে সে নিজের অর্জন মনে করে। এই ভেবে শান্তি পায় নোরা যে চোখের আড়ালে কাজ করে সে সবাইকে কিভাবে বোকা বানাতে পেরেছে।
আদতে পুতুল হচ্ছে টরভাল্ড। তাকে নোরা যা বিশ্বাস করাতে চায় সে তাই বিশ্বাস করে যায় যেখানে তার চোখের আড়ালে নোরা বিদ্রোহ করে উঠে প্রায়ই।
শেষাংশে, নোরা যখন তাকে বসিয়ে তার উপলব্ধির কথা বলে যায়, টরভাল্ড এর শোনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। নোরা এর এই উপলব্ধি যেন টরভাল্ড এর ভাষা কেড়ে নেয়। শুধু দেখা আর শোনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
নোরা তাকে বসিয়ে যেভাবে কথা শোনায় আর সে যেভাবে শুনে তার শোনার ভঙ্গিমা এর সাথে পুতুল এর তুলনাই চলে। টরভাল্ড কে সমাজ ব্যবস্থা এর পুতুল বলা যায়। কারণ এত কিছুর পরেও সে চায় নোরা যেন থাকে এই সংসারে।
কারণ সে সমাজের চোখে ছোট হতে চায় না। তাদের সম্পর্কের এই দশা সত্ত্বেও সে সমাজের সামনে হাসিখুশি দাম্পত্য দেখাতে চায় যা তার ভন্ডামী এর সাথে সাথে তাকে সমাজের পুতুল হিসেবেই সাব্যস্ত করে তার এই আচরণ।
‘A Doll's House’ নাটকে নোরা পুতুল হয়ে থাকে নিজের ইচ্ছায় কিন্তু সে নিজের নিজস্বতা কে হারিয়ে ফেলে না। কিন্তু টরভাল্ড সত্যি-ই পুতুল হয়ে থাকে নোরার কাছে, সমাজের কাছে।
আরো পড়ুনঃ রোমান্টিক যুগ: সমাজে অন্যধারার ব্যাপক পরিবর্তন