গোয়েন্দারা সব গেল কোথায়?

সেকালের গোয়েন্দারা পরতের সিল্কের কোট, পুরোহাতা শার্ট আর ধুতি। অপরাধী কে ধাওয়া করতেন ছ্যাকরস গাড়ীতে। আজকের গোয়েন্দা এসইউভি সওয়ার, ব্রান্ডেড শার্ট-প্যান্ট ও সানগ্লাসে শোভিত। অপরাধও বদলে যাচ্ছে। চেহারা, চরিত্র, মেজাজ। প্রিয়নাথ কল্পনা করতে পারতেন না সিন্ডিকেটের অস্তিস্ত্ব। ধর্ম ও রাজনীতির সঙ্গে তখনোও অপরাধের যোগ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এখন শখের গোয়েন্দা কে অনেক সময় পিছনে ফেলে দেয় পুলিশ গোয়েন্দা।

জুন 19, 2023 - 12:00
জুন 18, 2023 - 23:11
 0
গোয়েন্দারা সব গেল কোথায়?
গোয়েন্দারা সব গেল কোথায়? | Image Source: Espinof

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গোয়েন্দা গল্প লিখতে চান নি। সুকুমার সেন বলেন, আমেরিকা ও ইউরোপের এডগার এলেন পো প্রমুখ যেমন তাঁদের ছোট গল্পের সঙ্গে ক্রাইম কাহিনী কে মুক্ত রেখেছিলেন তেমনই রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পে সাধারণ মানুষ কে নিয়ে লেখা জীবনের ফাঁকে চুনো মাছের মতো ক্রাইম ঘটনা প্রবেশ করেছিলো- তালিকায় সম্পত্তি সমর্পণ, কঙ্কাল, মহসমায়া, নিশীথে, দিদি, সৎ পাত্রআর ডিটেকটিভ উল্লেখনীয়। এই সবে মৃত্যু, হত্যা, প্রতিহিংসা সব আছে (ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি - পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩১)


দীপক চ্যাটার্জি, ব্যোমকেশ, কিরীটি, ফেলুদা, শবর বা মিতিনমাসী- আমরা তাঁদের ক্ষুরধার বুদ্ধির কাছে হার মেনে হতভম্ব হাকরে শুধু চেয়ে থাকি। যদিও বলার একটা কথা যে বাস্তবের গোয়েন্দা ও গল্পের গোয়েন্দায় বিলকুল তফাৎ আছে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিষ্টি আর অধিকাংশ বাঙালী গোয়েন্দার মধ্যে সিনেমার পর্দার হুডানাইট গোয়েন্দার ধ্রুপদী চেহারা দেখতে পছন্দ করি ও আনন্দিত হই


এক সাবালক গোয়েন্দা গল্পতে এক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক জীবন তাতে সুখ, দুঃখ, ব্যর্থতার গল্প থাকে তাই ব্যোমকেশ বক্সী তদন্ত করতে নেমে অর্থমনোর্থম গল্পে কালো হরিণ নয়না সত্যবতীর প্রেমে পড়ে। এদিকে ব্যোমকেশের কাহিনীতে দেখেছি বহ্নি পতঙ্গ, আদিম রিপু, শজারুর কাঁটা, চিড়িয়াখানায় গোপন ষড়যন্ত্রের নানা রুপ। ব্যোমকেশের পুর্বসুরী দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনীও সাবালক কিন্তু জুমেলিয়া কামদেবের বক্ষ পাতিয়া দিল তার থরথর আবেগ ভরা চিঠিতেও চুম্বন, শরীরি মিলনের স্পস্ত ইঙ্গিত।


এমন ভিলেন বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে দুর্লভ। যদিও পরে স্বপন কুমারের গল্পে ইন্দো-চিনা অপরাধী লিউসিনের সঙ্গিনী ফ্লোরা কে দেখি রুপ যৌবনের আগুনের পরশমনি দিয়ে কার্য উদ্ধার করে এই ভিলেন রা। বিদেশে জেমস বন্ডের মতো নারী বিলাসে গোয়েন্দা বাংলায় দুর্লভ। যদিও ব্যতিক্রম অদ্রীশ বর্ধনের শরীরি বিভায় দীপ্ত যুবতী গোয়েন্দা নারায়ণী যার উদ্ধত বক্ষ, নিতম্ব, ওষ্ঠাধরের বর্ণনা বিদেশের ব্যাটম্যান, ফ্যান্টম লেডিদের মনে করায়।


সমরেশ মজুমদারের অর্জুন তিন যুবতীর গাইড হয়েও বেরসিক রুপে গন্য হয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অবিবাহিত শবর প্রেম ভালোবাসায় অজ্ঞ এই আখ্যা পান। এরা সবাই সাবালক গোয়েন্দায় আখ্যাত।


নাবালক গোয়েন্দার আখ্যান- ষষ্ঠী পদ চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডব গোয়েন্দা শার্লক হেবো, ফেলুদা তোপসে, কাকাবাবুর ভাইপো সন্তু সব নাবালক গোয়েন্দার সহায়ক হতে দেখা গেছে পুলিশ অফিসার বা বড় গোয়েন্দার।


পাঁচকড়ি দের শৈলিতে লেখা গোয়েন্দা গল্পর ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেও আজকের পাঠক চায় স্মার্ট সপ্রতিভ গল্পের জাদু। একালের গোয়েন্দা গল্পের পাঠক সমকালের প্রেক্ষাপটে গোয়েন্দা কে দেখতে চায়। তাই মোবাইল, ই-মে, ডেটিং সাইট, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদির ব্যবহার দেখি সাইবার ক্রাইম নিয়ে লেখা দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশী। ফেলুদাও তাই বোম্বাইয়ের বোম্বেটে তে মোবাইল ও  গোরস্থানে সাবধান এ ইন্টারনেট ব্যবহার জানেন দেখানো হয়।


মেয়ে গোয়েন্দা রুপে দেখা যায় আগাথা ক্রিষ্টির গোয়েন্দানী মিস মার্পল এর আদলে ঋতুপর্ন  ঘোষ নির্মিত শুভ মহরৎ রাঙা পিসিমাকে।


গোয়েন্দা কিরীটি রায় বলেছেন মানুষ মাত্রেই ক্রিমিনাল দুএকজন ছাড়া- গল্প বাঘনখ এক সর্বজ্ঞ সত্যানুসন্ধানীর হাত  ধরে সেই অপরাধ গোপন বিন্দু কে স্পর্শ করে, সে কালের রুপকথা ও এ কালের হ্যারি পটারের মতো শুভাশুভ দ্বন্দ্ব খোঁজা হয়। এক সাহিত্য তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম হয়েছে পোস্ট মর্ডা ডিটেকটিভ ফিকশন বা এন্টি ডিটেকটিভ নভেল।


সেকালের গোয়েন্দারা পরতের সিল্কের কোট, পুরোহাতা শার্ট আর ধুতি। অপরাধী কে ধাওয়া করতেন ছ্যাকরস গাড়ীতে আজকের গোয়েন্দা এসইউভি সওয়ার, ব্রান্ডেড শার্ট-প্যান্ট ও সানগ্লাসে শোভিত। অপরাধও বদলে যাচ্ছে। চেহারা, চরিত্র, মেজাজ। প্রিয়নাথ কল্পনা করতে পারতেন না সিন্ডিকেটের অস্তিস্ত্ব। ধর্ম ও রাজনীতির সঙ্গে তখনোও অপরাধের যোগ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এখন শখের গোয়েন্দা কে অনেক সময় পিছনে ফেলে দেয় পুলিশ গোয়েন্দা।


বাংলা অপরাধ সাহিত্যে পুলিশ আর গোয়েন্দা দু-ই এসেছে ইংরেজি সাহিত্যের হাত ধরে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, জনগণের নিরাপত্তা ও ধনসম্পদের সুরক্ষার প্রয়োজনে প্রাক ঔপনিবেশিক বাংলায় পুলিশ আইন কায়েম থাকলেও ব্রিটিশ আইনে রকমফের হলো। তার ছাপ সাহিত্যে এলো। ঠাঁই মিললো পুলিশের সাথে গোয়েন্দার, বাংলা সাহিত্যে যা রোল মডেল শার্লক হোমস- শখের গোয়েন্দা রুপে দুনিয়া জোড়া  নাম এবং এই শার্লক হোমসের সৃষ্ট হয়েছিলো পুলিশ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া রুপে।


সমাজ বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট মেন্ডেলের মতে, অপরাধ এক উৎপাদিকা শক্তি। যা থেকে সৃষ্টি অপরাধ, আইন, বিচারক, জুরি ইত্যাদি। পুলিশ ব্যবস্থায় বিমুখ বিত্তবান শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী বদল এলো ১৮৩০ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যে। কোনও উদয়াস্ত খেটে খাওয়া পুলিশ কর্মচারী কখনো নায়ক হয় নি গোয়েন্দা গল্পের সুচনা পর্বে। কোনও উচ্চবিত্ত, মেধাবী বেসরকারী গোয়েন্দা নায়ক হতো। এই সময় প্রবেশ গোঁড়া ভিক্টোরিয়ান শার্লক হোমস এর। বাইরে যেমন হোক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য ভিক্টোরিয়ান শার্লক হোমস এর ছিলো।


গোয়েন্দাগল্পর হিট ও সাময়িক শর্ত- অপরাধ থেকে প্রতিটি চরিত্র প্রথম থেকে পাঠকের পরিচিত হওয়া, গোয়েন্দার প্রতি চালচলন, জেরায় পাঠক তার সঙ্গে থাকবে, আর রহস্য বা অপরাধ যাই হোক তার বাস্তব সমাধান অতি আবশ্যক। কোনও ধার্মিক, ভৌতিক বা আধ্যাত্মিক সমাধান চলবে না।


আইকোনিক
, প্রাপ্তবয়স্ক, পরিণত ধ্রুপদী গোয়েন্দা পাঠকদের কাছে প্যাচপয়জার হীন কিশোর পাঠ্য গোয়েন্দা গল্প সোনার পাথর বাটি।


কিশোর পাঠ্য গোয়েন্দাকাহিনীর ট্রেন্ড সেটার অবশ্যই ফেলুদা (সত্যজিৎ রায়)। তাঁর গল্প বড়দের নয়। নারী চরিত্রবিহীন জটিল অপরাধ নেই, খুন, চুরি অপহরণ এ সীমাবদ্ধ।


হুডানিক স্টাইল (আগে আলোচিত হয়েছে) গোয়েন্দা গল্প এলেন পোর দ্য মার্ডারস ইন ল্য রুক মর্গ(১৮৪১), উইলকি কলিন্সের দ্য উয়োম্যান ইন হোয়াইট'(১৮৫৯) আর শার্লক হোমস এর গোয়েন্দা প্রত্যেকে প্রখর ধী শক্তিমান ছিলেন। শখের গোয়েন্দাদের কীর্তি কাহিনী কে পাঠক হুডানিক শৈলীতেই চিনে এসেছে। আজকাল যার অভাব। বাংলা বিদেশী আইকোনিক গোয়েন্দাচরিত্র কই! যা আছে যা আছে পুরাতন। এরকুল পোয়ারো, লর্ড পিটার হুইমজি, ফাদার ব্রাউন বা ইনস্পেকটর ডালগ্লিশ! এঁরা নন আধুনিক। একজন আছেন জে কে রাওলিংয়ের করমোরাল স্ট্রাইক


সমসাময়িক গোয়েন্দা কাহিনী তে প্রাপ্তবয়স্ক রহস্য তৈরী না করলে, আইকোনিক দুর, গোয়েন্দা কাহিনীর ধ্রুপদী ধারাটিও বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা।


কৃতজ্ঞতা

ঋতম মুখোপাধ্যায়

অরিন্দম দাশগুপ্ত

সুবর্ন বসু

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392