প্রবাসীরা কেন এত অবহেলিত!

প্রবাসীদের কষ্টের অর্জিত উপার্জনে সচল থাকে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা। অথচ এই প্রবাসী শব্দটাই যেন এক অবহেলার নাম। পরিবার,সমাজ, এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্র বিদেশেও অবহেলা নিগ্রহের শিকার হন তারা।

জুল 28, 2023 - 16:00
জুল 28, 2023 - 23:04
 0
প্রবাসীরা কেন এত অবহেলিত!
প্রবাসীরা কেন এত অবহেলিত! | Image Source: প্রথম আলো

বুকে কষ্ট মুখে হাসি এরই নাম প্রবাসী। দেশ এবং পরিবারকে তারা কেবল দিয়েই যান বিনিময়ে পান না তেমন কিছুই। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দেশ এবং দেশের বাইরে প্রায় সবখানেই অবহেলার শিকার হন এই সকল রেমিটেন্স যোদ্ধারা। এমনকি পরিবারের কাছেও অবহেলিত এই মানুষগুলো। পরিবারের কাছে তারা শুধু যেন টাকা কামানোর মেশিন, তারা যেন রক্তমাংসে গড়া জলজ্যান্ত এক টাকার মেশিন।


অনেক প্রবাসীর সাথে আলোচনা করে জানা যায়, পরিবার থেকে বেশিরভাগ সময় তাদের কাছে বেতনের কথা জানতে চায়। কি খাচ্ছে? কোথায় থাকছে? তা নিয়ে কারোর কোনো ভাবনা নেই। অথচ দেশ এবং পরিবারের জন্য তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু অকাতরে বিলিয়ে দেয়


দেশের মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবাসীদের অবদান। তাই দেশের অর্থনীতির চাকার সচল রাখতে তাদের সক্রিয় অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগই নেই। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম এবং রক্ত পানি করে উপার্জন করা রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ভাগ্যে জোটে অবহেলা, অপমান আর লাঞ্ছনা। এটিই যেন তাদের কষ্টের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি


সম্পূর্ণ অজানা একটি দেশে, নতুন একটি পরিবেশে জীবন যুদ্ধ শুরুর আগেই প্রবাসীরা হোঁচট খান ভাষা না জানার কারণে। তারপর শুরু হয় কর্মক্ষেত্র নিয়ে আরেক নতুন বিপত্তি। দেশ ছাড়ার আগে যাদের মাধ্যমে প্রবাসে পাড়ি জমান তাদের কথা আর কাজের মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতালবিশেষ করে দালাল চক্রের বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভনে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রবাসীরা


কর্মক্ষেত্র কিংবা কাজ পছন্দ না হলেও কয়েক লাখ টাকা খরচা দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশে ফেরার কোন উপায় থাকে না অসহায় প্রবাসীদের। তখন পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সবার কাছেই বোঝা হয়ে পড়েন সেই সকল রেমিটেন্স যোদ্ধারা। মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমানো প্রবাসীদের ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে কাজের জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়


কখনো ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি আবার কখনো বা মরুভূমির ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রির তাপদাহ সহ্য করে টানা কাজ করে যেতে হয় তাদেরকে। মাস শেষে কেউ কেউ আবার ঠিকঠাক মতো বেতনও পান না। বেতনের জন্য অনেককছ রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। অনেকের দুই থেকে তিন মাসের বেতন আটকে দেয় কোম্পানি


অনেক কোম্পানি আবার পুরো বেতন না দিয়ে প্রতি মাসে কিছু কেটে রেখে দেয়। সেই টাকা থেকে নিজের খাওয়া-দাওয়ার জন্য যেটা না রাখলেই নয় সেটা রেখে বেতনের পুরো টাকাই প্রবাসীরা পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। তবুও অনেক সময় পরিবার আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব কারো চাহিদা পূরণ করতে না পারলেই অনেক প্রবাসীদের মিথ্যাবাদীর অপবাদও সহ্য করতে হয়


অনেক সময় টানা ১৫ থেকে ২০ বছর প্রবাসে কাটানোর পর দেশে ফিরে অনেক প্রবাসী লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও বেঈমানির শিকার হন। দেশে পাঠানো টাকার হিসাব নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয় খোদ পরিবারের সদস্যদের সাথে। হাজির হয় বিদেশে থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন জমি জমা সংক্রান্ত সমস্যাও। এমন নানামুখী মানসিক চাপ এবং পারিবারিক নিগ্রহ সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অনেক প্রবাসী


বর্তমানে এটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালে কেবল সংযুক্ত আরব আমিরাতেই ১০ বাংলাদেশী প্রবাসী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এদের মধ্যে সবাই পারিবারিক কলহের কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। প্রবাসীরা এমনকি বিমানবন্দরে ও হয়রানির শিকার হন। লাখ লাখ প্রবাসী নিয়মিত বিদেশে যাতায়াত করেন


যারা বিদেশ থেকে ফেরত আসেন তারা আত্মীয়-স্বজনের জন্য সাধ্যমত মূল্যবান কিছু নিয়েই আসেন। তাই অনেক স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে প্রবাসীদের ব্যাগ এবং লাগেজের মধ্যে। কিন্তু তাদের ব্যাগ এবং লাগেজের কোন নিরাপত্তা থাকে না। যত্রতত্র ছুড়ে ফেলা হয়। এছাড়া বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু বিপদগামী কর্মচারীরা প্রবাসীদের সাথে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে


হুটহাট ভাড়া বৃদ্ধি করে দেওয়া, ঠুনকো অভিযোগে পাসপোর্ট জব্দ করে রাখা, তাদের রেখে বিমান ছেড়ে দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হন তারা। স্বাধীনতার ৫২ বছর বেরিয়ে এসেও দেশের এমন টাকা পাঠানোর মেশিনদের তেমন যোগ্য কোন মর্যাদা দেওয়া হয় নাতার চেয়েও বড় হতাশার কথা হলো, প্রতিনিয়ত প্রবাসীদের লাগেজ সহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ব্যাগ চুরি হয় বাংলাদেশ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে


একজন প্রবাসীর প্রবাস জীবনের কষ্টের মালামাল দেশে এসে, এমন নিরাপত্তা বেষ্টনী থেকে চুরি হলে এর কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সব জায়গা থেকেই প্রবাসীরা উপযুক্ত সম্মানের দাবিদার। যাদের টাকায় পরিবার এবং দেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে বিনিময় হিসেবে তারা একটু সম্মান পেতেই পারেন


প্রবাসীরা নিজেদের রক্ত পানি করে নিজেদের জীবন এবং যৌবন বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে ভালো রাখার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ করে টাকা ইনকাম করে দেশে পাঠায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেই টাকা দিয়ে প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা আমোদ ফুর্তি করে চলে এমনকি সেই সকল টাকার কোন ন্যায্য হিস্যা টাকার মালিককে তারা দেয় না


প্রবাসীরা শুধু সমাজের কাছে বা রাষ্ট্রের কাছেই নিগ্রহের শিকার হন না নিজেদের পরিবারের কাছে, নিজেদের রক্তের আত্মীয় স্বজন দের কাছ থেকে পর্যন্ত তারা নিগ্রহের শিকার হন, নিজেদের স্ত্রী, সন্তান এমনকি পিতা-মাতাদের কাছ থেকেও কোন কোন প্রবাসী নিগ্রহের শিকার হয়েছেন


একজন প্রবাসী একজন যোদ্ধা, একজন প্রবাসী একজন বীর, তাদের রক্ত ঘাম করা উপার্জনের টাকায় এই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। আজকে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ বিলিয়ন ডলারে রূপ নিয়েছে যার পিছনে অবদান রয়েছে এই সকল রেমিটেন্স যোদ্ধাদের। তাই আমাদের উচিত এই সকল জাতীয় বীরদের সম্মান করা অন্তত অসম্মান না করা

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

Abdus Sadik Content Writer