জাপান কেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু?
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান সরকার দৃঢ় পদক্ষেপে এসে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে জাপানে যে আন্তরিক ও সর্বোচ্চ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, জাপানের ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। জাপানের বাড়িয়ে দেওয়া সেই হাত আজও অব্যাহত আছে। অনেক দেশই সহযোগিতার পেছনে নিজস্ব স্বার্থ আদায়ের অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে রাখে। অসম শর্তে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জাপান তেমন কিছু করেনি। বর্তমান বিশ্বের যে অবস্থা তাতে জাপানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে আরো বেশি জোড় দেওয়া উচিত।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী দেশ হলো জাপান। সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভাগে সহযোগীতা করেছে জাপান। জাপান এমন নানা ধরনের সহযোগীতার পরও বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের রাজনৈতক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেনি বা কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে যেতে বাধ্য করেনি।
অন্যদিকে ঋণের হিসেবে জাপান বহুবার ঋণ মওকুফ করেছে এবং সুদের হার কমিয়েছে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান সরকার দৃঢ় পদক্ষেপে এসে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে জাপানে যে আন্তরিক ও সর্বোচ্চ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, জাপানের ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা।
জাপানের বাড়িয়ে দেওয়া সেই হাত আজও অব্যাহত আছে। অনেক দেশই সহযোগিতার পেছনে নিজস্ব স্বার্থ আদায়ের অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে রাখে। অসম শর্তে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জাপান তেমন কিছু করেনি। বর্তমান বিশ্বের যে অবস্থা তাতে জাপানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে আরো বেশি জোড় দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও জাপানের পতাকার মধ্যেকার সামঞ্জস্যই বাঙালি জাপানিজ সম্পর্ক পরিষ্কার ধারণা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ব্রিটিশদের কাছ থেকে বাংলা স্বাধীন করতে জাপানের রাজার সাহায্য কামনা করলে জাপানের রাজকীয় বাহিনী তার পদাতিক ও বিমান বাহিনী বাংলার অভিমুখে প্রেরন করে।
বাঙালি জাপানিজ বন্ধুত্বের স্বারক হিসাবে রয়েছে এই দুই দেশের পতাকা। বর্তমানে জাপান বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক
২০০৪ সাল নাগাদ, জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মালয়েশিয়ার মতো সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য চতুর্থ বৃহত্তম একটি উৎস হয়ে উঠেছিল। জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। ২০০১ সালে জাপানে প্রায় ৯৫,০০ বাংলাদেশী ছিল। জাপান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশ-জাপানের সম্পর্কের কয়েকটি বিশেষ ধাপ
মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড কিংবা এমনকি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জনজীবন ও সংস্কৃতির প্রভাব বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, বিশেষ করে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় কারণ ধর্মীয়। জাপানিদের একটি বড় অংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ নেপালের কপিলাবস্তুতে জন্মগ্রহণ করেন এবং পাল ও মৌর্য যুগে বাংলাদেশ অঞ্চলেই বৌদ্ধ ধর্মের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার ঘটে।
বাংলাদেশের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় আর ময়নামতিতে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা এবং এসব বিদ্যায়তন ও ধর্মশালাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে। এছাড়া ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বাংলাদেশের গাঢ় সবুজ অরণ্যানী শোভিত পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমির সমন্বিত সমাহার, অবারিত নৌপথ আর কৃষিজমি, পাহাড় আর সমুদ্রমেখলা ও নদীনালা বিধৌত অববাহিকা এবং এর আবহাওয়া যেন জাপানেরই প্রতিচ্ছবি। সমপর্যায়ের ভৌগোলিক ও নৈসর্গিক অবস্থানে জীবনযাপনকারী বাংলাদেশ ও জাপানের জনগণের অন্যতম খাদ্য ভাত ও মাছ। দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ হলো চতুর্থ কারণ।
অন্যদিকে কয়েকজন বাঙালি আছেন যাদের মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে ভালো হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা অবিসংবাদিত। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬, ১৯১৭, ১৯২৪ (দু’’বার) এবং ১৯২৯ সালে মোট পাঁচবার জাপান সফর করেন।
জাপানিদের কাছে ‘চান্দ্র বাসো’ নামে খ্যাত নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আজও জাপানে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। এখনো তার দেহভস্ম টোকিও শহরের রিংকিয়োজি মন্দিরে সংরক্ষিত। বিচারপতি ড. রাধা বিনোদ পাল জাপানিদের কাছে বাংলাদেশ-জাপান মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সেতু হিসেবে বিবেচিত ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। কুষ্টিয়ার সলীমপুরে ড. রাধাবিনোদের জন্ম। বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল যুদ্ধোত্তরকালে জাপানে দক্ষিণ এশীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। টোকিও ট্রায়াল শুরু হয় ১৯৪৬ সালের ৩ মে এবং শেষ হয় ১৯৪৮-এর নভেম্বর।
জাপানিদের মধ্যে তাকাশি হায়াকাওয়া (১৯১৭-১৯৮২) জাপান বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। তিনি একটানা ৪০ বছর জাপানের জাতীয় সংসদ ‘ডায়েট’-এ নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং ‘ফাদার অব দ্য ডায়েট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সংবাদে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ তাকাশি হায়াকাওয়ার চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। জাপানের ডায়েটে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে হায়াকাওয়া বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপানে বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শীর্ষ পর্যায়ের প্রথম সফরের সময় বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়, হায়াকাওয়া ছিলেন তার অন্যতম রূপকার। ১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় টোকিওতে তার সম্মানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা ও তার স্ত্রী প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের পটভূমি তুলে ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সহায়তা ও সমর্থনের জন্য জাপান সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
১৯৭৩ সালেরই ১৬ ডিসেম্বর হায়াকাওয়া সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এলে রাষ্ট্রাচার উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে পদ্মা গেস্ট হাউজে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও সম্মান প্রদর্শনে আসার ঘটনাটিকে জাপান-বাংলাদেশের মধ্যে সুদূরপ্রসারী সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সোপান বলে হায়াকাওয়া তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন।
সার্বিক দিক বিবেচননায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো ভালো হয়েয়েছ। অসামী এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আনো বেশি সুন্দর হবে এই প্রত্যাশা।
১৯৮১ সালের আগস্টে হায়াকাওয়া শেষবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন ঢাকায়, তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জাপানি সহায়তায় সোনারগাঁও হোটেলের উদ্বোধন উপলক্ষে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর জাপান সরকার ও জনগণ বেশ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনার পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাদেশ সরকারও জাপান-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে জাপানই হচ্ছে এশিয়ায় বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের অন্যতম গন্তব্যস্থল। আবার জাপানি পণ্য বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যের অনেকটা দখল করে আছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?






